ঢাকা ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পারিবারিক সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার বন্ধন প্রয়োজন

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার
সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পারিবারিক সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার বন্ধন প্রয়োজন

অস্থিরতা আমাদের সমাজব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে। সব কিছুর মূলেই যে রাজনীতি তা কিন্তু নয়। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে প্রায় সময়ই সামনের পথে যেতে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে মানুষ। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা প্রতিনিয়তই হাঁটছি অন্ধকারের পথে। আবার মনে হয় হতাশ হলে তো চলবে না। আর হাতাশাবাদীদের পক্ষেও আমি নই। হতাশার মধ্য থেকেও সুন্দর একটি সূর্যের দেখা পেতে চাই।

শিক্ষা আমাদের জীবনের শক্ত খুঁটি হলেও শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর বাস্তবায়নে পঁচন ধরেছে এরই মধ্যে। আমরা শিক্ষার বাহ্যিক দিকে সংস্কার করার জন্য উদ্যোগী হলেও এর ভেতরের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারছি না। অন্যদিকে ধর্মের মূল বিষয়গুলো আমরা অন্তরে লালন করতে ব্যর্থ হচ্ছি।

ধর্মের লেবাসটা ধারণ করার জন্য চেষ্টা করছি; কিন্তু ধর্মের রস আস্বাদন করতে পারছি না। সবকিছুই যেন বাহ্যিক দিক দিয়েই বিবেচনা করছি। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিপথের আশ্রয় নিচ্ছি। ব্যক্তি জীবনে বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হলেও বাড়ছে না সামাজিক বন্ধন। বেড়েই চলেছে সামাজিক অস্থিরতা। আজ এক বিষয় আবার কাল অন্য বিষয়। পাল্লা দিয়ে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে সমাজের সব স্তরে। এ থেকে মুক্তির পথ তৈরির কোন সুস্পষ্ট লক্ষণও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। একটা সময় মানুষের মাঝে সামাজিক বন্ধন ছিল অনেক শক্তিশালী। সামাজিক বন্ধনটাতে আজ বিচ্ছেদের সূর পরিলক্ষিত হচ্ছে। সব কিছুর মাঝে একটি বন্ধনের অভাব আমাদের তাড়া করছে। কিন্তু এ অবস্থান কেন হচ্ছে তা কিন্তু আমরা নির্ণয় করতে পারছি না বা করার চেষ্টাও করছি না। কিন্তু একটি সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে শুধু রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব নয়। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকু সময়ের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরের ভূমিকা অনস্বীকার্য এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

এখন প্রশ্ন হলো- সমাজের যে ভূমিকার কথা আমরা বলছি তা আমাদের বর্তমান জীবনে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। হতাশাগ্রস্তরা হয়তো বলবে কোনো কাজেই আসছে না সমাজের এ ধ্যানধারণা। কিন্তু একটু স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলেই সমাজের ভূমিকার কথা চোখে ও মনে ভেসে ওঠে। তবে এও সত্য যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সমাজের ব্যবস্থাটা মানুষ ব্যবহার করতে চাইছে না বা পারছে না। এর জন্য বিশেষ কোনো গুষ্ঠী বা ব্যক্তিকে কোনো এককভাবে দায়ী করা যায় না। কাগজে লেখা বা বক্তব্য দেয়া সহজ হতে পারে; কিন্তু সমাজের পরিবর্তন বা সুস্থ ধারায় নিয়ে আসা, ততটা সহজ কাজ নয় বা একক কোনো ব্যক্তির প্রচেষ্টায় তা সম্ভবও নয়। প্রতিটি প্রজন্ম আরেকটি প্রজন্ম থেকে জ্ঞানে বা মেধায় আলাদা হবে এটা স্বাভাবিক বিষয়; কিন্তু একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটি প্রজন্মের পরিবর্তনটা হতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এই যে পরিবর্তনের বাজনা আমরা বাজাচ্ছি আসলে তা কি পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তন কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে তা কিন্তু আমরা ভেবে দেখছি না। প্রথমেই নজর দেয়া যাক পরিবারের দিকে। জন্মের পর থেকেই পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে মানুষ বয়সে বড় হতে থাকে। পরিবার থেকে আমরা যা শিক্ষা লাভ করছি তা আমরা প্রতিনিয়ত সমাজব্যবস্থায় বেঁচে থার জন্য প্রয়োগ করছি।

বর্তমানে পারিবারিকভাবে যে শিক্ষাটা আমরা গ্রহণ করছি সে শিক্ষার মাঝে এখন চরম অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেক জায়গায় সামাজিক মূল্যবোধের অভাব লক্ষণীয়। আমার ছাড়া পরিবার আর কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না। প্রত্যেক জায়গায় আমার আমার শব্দের জয়জয়কার। যেকোনোভাবে আমরা অর্থনৈতিকভাবে এতই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি যে, যেখানে পারিবারিক বন্ধন বিলীন হলেও কোনো সমস্যা নেই। সবচেয়ে দেখার বিষয় এই যে, অর্থের প্রভাবের কারণে রক্তের বন্ধনই ছিন্ন করছি সামাজিক বন্ধনতো দূরেই রয়ে যায়। পারিবারিক বন্ধন মজবুত না হওয়ার কারণে শুধু নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্যের ভালোর দিকটা চিন্তা করতে পারছি না। শুধু টাকার একটা মেশিন বানানোর জন্যই আমরা সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলছি।

পরিবার থেকে বড় হওয়ার যে একটা চাপ তৈরি করা হচ্ছে, সে চাপেই অন্য পথ ভুলে যাচ্ছি আমরা। জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে গিয়ে সমাজের অনেক ভালো কাজের কথাও কাগজে লিখছি কিন্তু করছি না। প্রত্যেকটি বড় হওয়ার পেছনে শুধু টাকার বড় হওয়াটাই দেখছি; কিন্তু পরিবার ও সমাজের ভাবনাটা একেবারেই আসছে না আমাদের মাঝে। প্রত্যেকটি সন্তানই যখন তার তার নিজকে কেবল চিনে তখন তার কাছ থেকে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবনাটা অনেক দূলে চলে যায়। এই যে ভাবনা যার ভিন্নতা আনতে পারে কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং তাকে সমৃদ্ধ করতে পারে ধর্মীয় চিন্তা। কিন্তু সত্য এটা যে দু’জাগাতেই পঁচন ধরেছে। এর জন্য এককভাবে কোন সমস্যাকেই দায়ী করা যায় না। আমরা শুধু আধুনিকতার দোহাই দিচ্ছি।

পৃথিবীর পরিবর্তনের রীতিনীতির কথাই শুনাচ্ছি। কিন্তু আসলেই কি সকল রীতিনীতি এভাবে ছন্নছাড়া হচ্ছে এটা ভেবে দেখা দরকার। আমরা পরিবর্তনের বেলায় অন্যের বিষয়টার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি বেশি; কিন্তু নিজেরটা চোখে পড়ছে না। কারণ যেকোনো মূল্যেই আমাকে প্রথম হতে হবে। এখানে নীতি থাকুক আর নাই থাকুক। বিভিন্নভাবে ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হলেও মূল বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। মানা না মানা অন্য বিষয়। মতের পার্থক্য থাকতেই পারে। মতের বিরোধ থাকলে ভালো মত পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা মত নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে; কিন্তু এ দ্বন্দ্বের অবসান হতে হবে সঠিক পথে। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক পারিবারিক ব্যবস্থার পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক; কিন্তু সেটা যদি হয় সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ভালো থাকার জন্য বাঁধা তাহলে এ বিবর্তনের ফলতো ভালো হওয়ার কথা নয়। একটি পরিবর্তন অন্য আরেকটি খারাপ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। প্রত্যেকটি পরিবর্তনের সময় অবশ্যই আমরা এমন পরিবর্তন আশা করি, যা থেকে সমাজব্যবস্থায় ব্যতিক্রম পরিবেশের সৃষ্টি না হয়। সুন্দর সমাজব্যবস্থা নির্মাণ করতে না পারলে আধুনিকতার যে ছোঁয়ার কথা আমরা বলছি তার ফল লাভ করা যাবে না। আর এ ফল লাভের ক্ষেত্রে অবশ্যই যে বিষয়গুলো সামনে আসছে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। বড় হতে হবে তবে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে নয়। আর এ বড় হতে গিয়ে যেন আমরা আমাদের অস্তিত্ব ভুলে না যাই।

শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চালানো সম্ভব নয়। আবার অর্থনৈতিক উন্নয়ন না ঘটলে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে আছে। এই যে জড়িয়ে থাকার ধরন সেটা নিরুপণ করে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। আর এই যে প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, সেসব জায়গায় আত্মিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

অন্তরকে জাগ্রত করাতে পারে সেরকম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর চিন্তা না করে। আমার পরিবার থেকেই এর যাত্রা শুরু করা একান্ত প্রয়োজন। সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা তৈরি করা এখন সমাজের দাবি কারণ বিনষ্ট সমাজব্যবস্থার কুফলের ভোগের বাইরে কেউ নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত