মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভাব সঠিক মানুষের। হাজারো মানুষের মাঝে থেকেও যদি শূন্যতা অনুভূত হয় তবে তা অসুখ। এই ব্যাধির অন্যতম কারণ মনের মানুষ না পাওয়া কিংবা মনের মত মানুষ না থাকা। রোজ কত-শত মানুষের সাথে ওঠাণ্ডবসা হয়, কত চেনা-অচেনা মুখের সাথে কথা-দেখা হয় কিন্তু মতের মানুষ ও মতবাদের সঠিক মানুষের সাথে দেখা না হলে জীবন বিষিয়ে ওঠে। শূন্যতা ভর করে চিস্তায়। হরেক মানুষের সাথে যে কারবার সেখানে যদি আন্তরিকতা না থাকে, বিশ্বাস না বাঁচে কিংবা আস্থালাভ না হয় তবে জীবনের পুরোটাই লস। মানুষের মন বুঝতে পারে, অভিমান পড়তে পারে কিংবা ইচ্ছা শুনতে পারে- এমন মানুষ জীবনের চারপাশে কতজন? প্রয়োজন শেষে যারা ফুরিয়ে যায় তারা প্রিয়জন হয় না।
নানা রঙের মানুষের মাঝে থেকেও একাকীত্ব অনুভব হলে, নিজেকে হারিয়ে ফেললে কিংবা ইচ্ছা পুড়িয়ে ফেললে- জীবন মেরামত দরকার। শূন্যতার অনুভব এমনি এমনি জন্ম হয় না। মন যত্ন না পেলে, অবহেলা-অবজ্ঞায় পতিত হলে কিংব অপমান-অপদস্ত হতে বাধ্য হলে মানুষের সঙ্গ বিষিয়ে ওঠে। যে মানুষ যত বেশি মানুষকে জেনেছে সে তত একা হতে চেয়েছে। কারো বাহিরের রূপ দেখে ভেতরটা পড়া যায় না। মানুষ ক্ষুধা সহ্য করতে পারে, ভয়ের সাথে মিতালি গড়তে পারে কিন্তু উপেক্ষা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নাই। অবহেলায় মন মুষড়ে পড়ে অথচ একজীবনে মানুষ সবচেয়ে বেশি পায় উপেক্ষা। বাধ্য হয় অনাদরে অভ্যস্থ হতে। পথ নেয় এক হতে। ভুল মানুষের সাথেও জীবন কাটানো যায়, ভুলের মিছিলে অংশগ্রহণ করা যায় তবে সে জীবনটা ভুলে ভুলেই গেলো! কত ফুল ভুল মুকুলে জন্ম নিয়ে আর ফুটতে পারলো না। তখন জ্যোছনা উপভোগ্য হয় না, সাগর-পাহাড় মন টানে না কিংবা গল্পের আসর আর জমে না। এক পেয়ালা চা-কফিতেও যে জীবন রঙিন হতে পারে তা একলা মানুষ জানেই না। যে ভুল ঠিকানায় হারিয়ে গেছে সে কল্পনা করতে পারে কিন্তু বাস্তবতায় সুখকে ছুঁয়ে দেখা হয় না। আড্ডার মাঝপথে হারিয়ে যাওয়া, কল্পনায় আফসোস গড়িয়ে পড়া- এসব কারণ ছাড়া জন্মে না। অবহেলা যখন গাঢ় হয়, সম্পদ-ক্ষমতার পেছনে জীবন পাগলের মতো ছোটে কিংবা রোবটের মতো রুটিনে জীবনের কাঠিন্য ধরা পড়ে- তখন সে জীবন পৌষের সকালের মূল্য বোঝে না। যে বোঝে টাকা আর যে বোঝে ভোগ- জীবন তাদের বিরুদ্ধে কত ক্ষোভ পুষে রেখেছে তা তারা বুঝতেও চায় না, বুঝতেও যায় না। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় সমস্ত শরীরে যে ঝাঁকুনি দেয় তাতে মন রঙিন হয়ে উঠে। এই আভা দেখার জন্য জীবন দর্শক চায়। গল্প শোনার জন্য শ্রোতা চায় কিংবা পথচলার জন্য চায় সঙ্গী। একলা মানুষ মন-মগজে শক্ত হয়ে কতক্ষণ বাঁচতে পারে কিন্তু মন ভালো থাকে আর অল্পক্ষণ। শূন্যতা যখন ধেয়ে আসে, মতের অমিল যখন চেপে ধরে চারপাশ তখন মানুষ হাহাকার করে ওঠে। তখন অতীতে পড়ে থাকে আফসোস এবং ভবিষ্যতে অপেক্ষা করে অন্ধকার। মানুষ আগমনে ও প্রস্থানে একা বলেই পথিমধ্যে সে আশ্রয় চায়। কেউ তার ভরসা হোক, হাত ধরুক এবং একসাথে চলুক- প্রার্থনা করে। অথচ অধিকাংশ মানুষকে একাই থাকতে হয়। সবাই আছে, সবার মাঝেও আছে তবুও ভয়ঙ্কর রূপে একা। যে অমাবস্যার নীল অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেছে সুখ তাকে ফেরানো দরকার!
সবার মধ্যে থেকেও একাকীত্বে ভোগার যে অসুখ সেটা যত্ন করে সারাতে হবে। একাকীত্ব মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে, নেশাগ্রস্ত করে এবং অসামাজিক বানায়। মানুষের দানব হয়ে ওঠার গল্পের কোন এক পরতে একাকীত্বের ব্যাধি ছিল। যে মানসিকভাবে ভালো নাই সে শারীরিকভাবেও সতেজ থাকে না। শূন্যতার প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে হবে। যদিও মানুষের বিকল্প বই নয় তবে একাকীত্বের সময়ে বই সঙ্গ দিতে পারে।
ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দিয়ে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে। সঠিক মানুষদের আসরে নিজেকে খুঁজে নিতে পারলে অসময় সংক্ষিপ্ত হবে। ভুল মানুষ আর ভুল সময়- যাচাই করে এগিয়ে চলতে হবে। এড়িয়ে চলতে হয় মনের অসুখ। নিজে স্বচ্ছ থাকলেও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাতে মনে ধাক্কা লাগতে পারে তবে ধাতস্থ হতে সময় লাগবে না।