কবি জসীম উদদীন ছিলেন লোকায়ত ধারার কবি, লোকায়ত সংস্কৃতির কবি এবং একই সাথে আধুনিক কবি। কবি জসীম উদদীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। অম্বিকাপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে কবির শৈশব কাটে। তার পিতা আনসার উদদীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। কবির মাতা রাঙ্গাছোটু ছিলেন একজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদদীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে রিসার্চ ফেলো পদে কর্মরত ছিলেন। দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের পল্লী এলাকার মানুষের মুখে মুখে গীত-পঠিত পুঁথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন। ড. সেন তাঁর উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদদীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেই সব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুঁথি সংগ্রহকালে গ্রামীণ জনপদের আনন্দ বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাঁটি মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারী, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীত আসরের আয়োজন করতেন। তিনি বেশ কিছু লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। কবি পৃথিবীর বহুদেশ সফর করেছেন। সেই সব দেশের লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্রবন্ধ গ্রন্থ, লোক-সাহিত্য, গবেষণা গ্রন্থ, গানের বই, ভ্রমণ কাহিনী এবং তার নিজের আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতের অধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবার্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুগোশ্লাভিয়াসহ বহুদেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তার গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে; তার ‘মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটির রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। কবি জসীম উদদীন ছিলেন বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির নির্ভরযোগ্য ও শক্তিমান প্রতিনিধি ও আধুনিক কবি। তাই তিনি সাহস নিয়ে বলতে পেরেছিলেন- ‘তোমার গেঁয়ো মাঠটি আমার মক্কা হেন স্থান।’ জসীম উদদীন সংকীর্ণ অর্থে পল্লীকবি নন। কেননা জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা কিংবা বেদের মেয়ে ইত্যাদির উপাদান-উপকরণ পল্লীতে পাওয়া গেলেও কোনো গৃহস্থ ঘরে এসব প্রাপ্তি রীতিমতো দুঃসাধ্য। এছাড়া শিল্পসম্মত কাহিনী বুনন, কবিতার শব্দচয়ন, উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক নির্মাণে এ সত্য প্রমাণ করে না। রাখালী, কবর কিংবা পল্লীজননী যে কোনো একটি কবিতা নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে- জসীম উদ্দীনের কবিতায় কিংবা কব্যোপন্যাসে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার বড় একটা দেখা যায় না। যে দু’চারটি প্রয়োগ দৃষ্টিগোচর হয় তাও মার্জিত এবং কুশলী হস্তে ব্যবহৃত। সুতরাং জসীম উদ্দীনে একজন পল্লীকবির চরিত্র ও চারিত্র্য মোটেও ধরা পড়ে না। যদিও বলা হয়ে থাকে, তাঁর মতো এমন ষোলআনা পল্লী দরদী কবি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এর অর্থ এই নয় যে তিনি পল্লীকবি। বড়জোর ‘লোককবি’ বলা যায়। তিনি কেবল পল্লী কবি নন। তিনি লোকায়ত সংস্কৃতির কবি ও আধুনিকতার কবি। কারণ গ্রামজীবন ও পরিবেশ তার কাব্যে উপাদান জুগিয়েছে এবং তাঁর কবিতাণ্ডকলাকুশলের মধ্যেও গ্রাম্য আবহকে আমরা মূর্ত হতে দেখি। কিন্তু তাই বলে তিনি শুধু পল্লী কবি নন। তার চারণ-উপমা-রূপক প্রয়োগে তিনি যথেষ্ট মুনশীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। জসীম উদদীন আসলে আধুনিক কবি। কারণ তিনি যেসব উপমা ব্যবহার করেছেন সেগুলোর উপাদান গ্রাম থেকে সংগৃহীত হলেও এর ব্যাখ্যাসূত্র প্রধানত নাগরিক। আবু সয়ীদ আইয়ুব আধুনিক শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক হিসাবে যারাই আধুনিককালে কবিরূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রতিভা ও সাধনার, যুগ্ম অধিকারে, তারাই আধুনিক কবি যুগলক্ষণ অধিকৃত না হলেও। সুতরাং এ অর্থেও জসীম উদদীন আধুনিক কবি। অন্য পক্ষে ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার ভাব প্রকাশ ও আঙ্গিকে যারা পরিবর্তন এনেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কবি তিনি। শুধু গ্রামীণ কবি ছিলেন না। কাহিনী কাব্য, ছন্দ ও গীতিময়তায় তিনি বাংলা কাব্যের নয়াদিগন্ত উন্মোচন করেন। তাকে বাদ দিয়ে আধুনিক কবিতার কথা চিন্তা করা যায় না। আধুনিকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি- ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ আবার জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, ‘বাংলা কাব্যে কিংবা কোনো দেশের বিশিষ্ট কাব্যে আধুনিকতা শুধু আজকের কবিতায় আছে- অন্যত্র নয়, একথা ঠিক নয়।’ আবার কেউ বলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত অন্তত মুক্তিপিয়াসী কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’