গত শুক্র ও শনিবার সকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ নিয়ে দুই দিনের জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন, ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন- এই তিনটির কোনোটি ছাড়া সাফল্য আসবে না। ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। সংস্কারের জন্য গঠিত ১৫টি কমিশনের প্রতিবেদন আগামী জানুয়ারিতে জমা হবে বলে আশা করছি। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিটি সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, প্রধান বিকল্পগুলো চিহ্নিত করে তার মধ্য থেকে একটি বিকল্পকে জাতির জন্য সুপারিশ করা। যার যার ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কীভাবে রচিত হবে, তা বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে সুপারিশমালা তৈরি করে দেয়া। এতে নাগরিকদের পক্ষে মতামত স্থির করা অনেকটা সহজ হবে। কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করলেই আমাকে আপনাকে তা মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। রাষ্ট্রকাঠামো এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যে সংস্কারের কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন তা যথার্থ, বাস্তবোচিত এবং এটাই হওয়া উচিত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এ বিষয়গুলোই প্রাধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর তার শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রতিটি কাঠামো যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তা মেরামতের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে। সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে সুদৃঢ় করতে না পারলে রাষ্ট্র ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়ে যেতে পারে। আগে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হবে। জনপ্রশাসন, সংবিধান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচনি ব্যবস্থা, আদালত, অর্থনীতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যদি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো না যায়, তবে দেশকে কোনোভাবেই গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সভ্য দেশের পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এজন্য সময়ের প্রয়োজনে এবং সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার জন্য সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নিকৃষ্টতম শাসন দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। পেছনে পড়া দেশকে সংস্কারের মাধ্যমে বর্তমানে এনে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সংস্কারের বিকল্প নেই। এজন্য সময়ের প্রয়োজন। আমরাও শুরু থেকেই সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দেয়ার কথা বলে আসছি। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও বলেছেন, সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় ও সহায়তা করা হবে। কারণ, সংস্কারের কাজটি তাড়াহুড়োর নয়। এটি অত্যন্ত গভীর চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার বিষয়। এমন সংস্কার করা যাবে না, যাতে পরবর্তীতে মনে হতে পারে, এটা যথাযথ হয়নি। অন্যদিকে নির্বাচন হচ্ছে, গণতন্ত্র উত্তরণের প্রথম সোপান। সেটিও যত দ্রুত হয়, তত মঙ্গল। এই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, সংস্কার ও নির্বাচন যতই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি হোক, এসব করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের স্বস্তি, শান্তি এবং সুখ-দুঃখের কথা ভুলে গেলে চলবে না। দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে রয়েছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তারা ভালো থাকলে, দেশ ভালো থাকবে।
সাধারণ মানুষ কিংবা একজন দিনমজুর সংস্কার-নির্বাচন তত বোঝে না। তারা বোঝে, দুবেলা দুমুঠো ভাত কীভাবে খাবে। শেখ হাসিনার সময় থেকে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্ব গতিতে মানুষের যে নাভিশ্বাস উঠেছে, তা কমানো যায়নি। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা আশা করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে, তা আসেনি। এতে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করা স্বাভাবিক। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুনসহ নানা অপরাধ বেড়ে গেছে। তারা পড়েছে উভয় সংকটে। একদিকে খাবারের চিন্তা, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, সংস্কার খুব বড় স্বপ্ন। এর জন্য ঐক্য দরকার, নির্বাচনেও যেতে হবে। তার আগে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের পাশাপাশি মানুষকে এই স্বস্তির জায়গাটা করে দিতে হবে। একটি করতে গিয়ে, আরেকটি থেকে মনোযোগ হারালে চলবে না। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সরকারের অনেক ক্ষেত্রে অপচয় হচ্ছে। হেলিকপ্টারবাজি হচ্ছে। নতুন দল গঠনের প্রয়াসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব সরকারের দায়িত্বশীলদের না করাই ভালো। রেকর্ড মূল্য স্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রের ভেদাভেদ ভুলে প্রতিদিনই টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। মানুষের আয় ও সক্ষমতা কমে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হচ্ছে। বড় বড় কর্পোরেট ও উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেকটা নিরুপায় হয়ে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করছে। অর্থনীতির সবক্ষেত্রে স্থবিরতা দৃশ্যমান। সরকারকে এদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। সাধারণ মানুষই যদি ভালো না থাকে, তাদের জীবন না চলে, প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় থাকতে হয়, তাহলে যতই সংস্কার করা হোক, তাতে কি লাভ? সংস্কার যেমন করতে হবে, তেমনি মানুষের জীবনযাপনের সুবিধা-অসুবিধাগুলোও তো দেখতে হবে। সরকারের এখন উচিত, সাধারণ মানুষের চাওয়াকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া। তাদের জীবন সহজ করে দেয়ার দ্রুত উদ্যোগ নেয়া। খাদ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ভয়-ভীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা।