রানি এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের দু’বছর পরে ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি লন্ডনের প্রখ্যাত ইয়র্ক হাউস বাসভবনে ফ্রান্সিস বেকন জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম স্যার নিকোলাস বেকন। তিনি এলিজাবেথের প্রধান মন্ত্রণাদাতা ছিলেন। ফ্রান্সিস বেকনরা ভাই-বোন মিলে আটজন। বেকন ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কথিত আছে যে বেকন রানি এলিজাবেদের অবৈধ সন্তান। ঘটনা যাই হোক, বেকন পরিবার অত্যন্ত উচ্চ সম্প্রদায় এবং তদানীন্তন সময়ের রাজনীতি বিশারদদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। মা এ্যানিকুক ছিলেন স্যার এ্যান্থনিকুকের কন্যা। বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারিনী এ্যানিকুক ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা। ধর্মীয় চেতনাসম্পন্ন নারী যিনি গির্জার সংস্কারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বেকনের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।
শৈশবে লেখাপড়া শিখেছেন গৃহে, ১২ বছর বয়সে ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হয়েছিলেন ট্রিনিটি কলেজে। শিক্ষা শেষে ১৫৭৫ সালে ফিরে এলেন লন্ডনে। আইন অধ্যয়ন করতে শুরু করলেন। আইন শিক্ষা সমাপনান্তে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জুনিয়র সেক্রেটারি রূপে প্যারিসে ইংরেজ দূতাবাসে তিনি কর্মে নিযুক্ত হন। অসাধারণ মেধাবী ছাত্র বেকন, দুর্লভ পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী বেকন রাজনীতি সম্বন্ধে ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে বেকন ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুনরায় আইন শিক্ষায় মনোনিবেশ করলেন। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য ও দর্শনই ছিল তার একান্ত অনুরাগ। কিন্তু অনুরাগ যাই হোক অর্থোপার্জনের জন্য আইন অধ্যয়ন তাকে করতে ইহল। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আইন ব্যবসায় যোগ দিলেন। কিন্তু বেকন অল্পে সন্তুষ্ট নন। তার লক্ষ্য ছিল আরো সুদূরে। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে পার্লামেন্টের সদস্য হলেন। কিন্তু করিতকর্মা বেকন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না। অর্থাৎ রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে কোনো স্বীকৃতি লাভ করতে পারলেন না। এমনকি প্রভাবশালী মামা শ্বশুর লর্ড বার্গলের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পেলেন না। ফলে পার্লামেন্ট, আইন ব্যবসা আর অধ্যয়ন হলো তার একমাত্র কর্ম। কিন্তু লক্ষ্যও তিনি ত্যাগ করলেন না। উচ্চপদে অধিষ্ঠত হওয়ার প্রবল বাসনা নিয়ে তিনি আর্ল অফ এসেক্সেও সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।
আর্ল অফ এসেক্স ছিলেন তার শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি প্রচুর সম্পত্তি বেকনকে দান করেছিলেন। তিনি তার জন্য রানি এলিজাবেথের কাছে বার বার দরবার করেছেন। কিন্তু ফল হয়নি; সেই এসেক্স যখন রাজদ্রোহীর অপরাধে অভিযুক্ত হন, তখন বেকনই তার আইনের শাণিত যুক্তির সাহায্যে তাকে ফাঁসির দড়িতে মৃত্যুবরন করতে বাধ্য করলেন। বেকনের এই বিশ্বাস ঘাতকতায় রানি এলিজাবেথ খুশি হলেন বটে; কিন্তু কোনো অনুগ্রহ লাভ করতে বেকন সক্ষম হলেন না। যদিও বেকন মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে গেলেন তবুও আপনার অসাধারণ প্রতিভা বলে বেকন পার্লামেন্টের একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে গণ্য হলেন। সময়ে সময়ে রানির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আরো বেশি করে তিনি তার বিরাগভাজন হলেন। বেকন আপনার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণের কোনো ন্যায়নীতির মুখ চেয়ে চলতেন না। রানি এলিজাবেথের রাজত্বকালে রাজনৈতিক জীবনে আত্মপতিষ্ঠিত হতে পারলেন না তিনি।
কিন্তু অধ্যয়নও তিনি ত্যাগ করেননি। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি Bencner হলেন, ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে হলেন ‘রিডার’। ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ করলেন। সাহিত্যের জগতে তিনি নিজের স্থান দখল করে নিলেন। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হলেন ‘ডবল রিডার’।
১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রথম জেমস সিংহাসনে আহরণ করলেন। এখন থেকে বেকন সতর্ক হলেন। রাজার সঙ্গে কোনো বিরোধে গেলেন না বরং অতিমাত্রায় চাটুকারবৃত্তি করতে লাগলেন। ফলে সিদ্ধিলাভ করার পথ উন্মুক্ত হল। ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হলেন। ১৬০৭ সালে হলেন ‘সলিসিটর জেনারেল’, ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে হলেন ‘অ্যাটর্নি জেনারেল’। সুতরাং লক্ষ্য যখন মিলেছে, তখন ভোগবাসনাও বেড়েছে। ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের এক বিখ্যাত বণিককন্যা এলিস বার্মাহামকে তিনি বিয়ে করেন। প্রচুর অর্থের মালিক হলেন। বসবাসের বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করলেন। আধুনিক আসবাবপত্র সাজ-সজ্জায় সুসজ্জিত হলো সে প্রাসাদ। ব্যয়ের মাত্রা বেড়ে গেল অত্যাধিক। তা সত্ত্বেও অনলসভাবে প্রচেষ্টা চালালেন আরো উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে। রাজার অত্যন্ত প্রিয়-ভাজন বাকিংহামকে তিনি খোশামোদের দ্বারা সন্তুষ্ট করতে লাগলেন। রাজার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক তত্ত্ব- ‘the divine right of kingshilp’ রাজতন্ত্রের দৈব অধিকারকে তিনি সমর্থন জানালেন। গণতন্ত্রের শত্রুরূপে যদিও তিনি চিহ্নিত হলেন কিন্তু পুরস্কারস্বরূপ পেলেন ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘লর্ড চ্যান্সেলর’ পদ এবং দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠলেন। ঘুষ, জালিয়াতি, জোচ্চুরি তিনি ব্যাপকভাবে চালাতে লাগলেন। ফলে জনতার পুঞ্জীভূত অসন্তোষ জেগে উঠল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, রাজার বিরুদ্ধে। ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দে পার্লমেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসন্তোষ ফেটে পড়ল। লর্ড চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণসহ দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো। রাজা বাধ্য হলেন তদন্ত কমিশন গঠন করতে। তদন্ত কমিশনের রায়ে তিনি দোষী অভিযুক্ত হলেন এবং বিচারে অনিবার্য মৃত্যুদণ্ড জেনে তিনি বিচারকের কাছে প্রাণভিক্ষা করলেন। বিচারকরা রায় দিলেন- তাকে ৪০ হাজার পাউন্ড খেসারত দিতে হবে, টাওয়ারে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে; র্যাজ্যের কোনো উচ্চপদে বা সরকারি পদে যোগ দিতে পারবেন না; পার্লামেন্ট অথবা আদালতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কয়েকদিন কারাদণ্ড ভোগের পর রাজঅনুগ্রহে তিনি মুক্তি পেলেন। ফিরে গেলেন কলঙ্কিত জীবন নিয়ে নিজগৃহে। সেখানে লেখাপড়া আর অধ্যয়নে মনোনিবেশ করলেন। সাংসারিক জীবনেও ছিল না শান্তি। স্ত্রীর সাথে অনেক আগে বিচ্ছেদ ঘটেছিল। নিঃসঙ্গ জীবনে গ্রন্থই হলো তার একমাত্র সান্ত¡না ও সাধনা। ৫ বছর পরে ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল বেকন মারা গেলেন। তার রোগশয্যার পাশে সেদিন কোনো প্রিয় পরিজন ছিল না। ছিল না চোখের জল আর সমবেদনা জানানোর জন্য কোনো বন্ধু। অনাদরে, অবহেলা, শুশ্রুষার অভাবে মারা গিয়েছিলেন বেকন।
কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যকে তিনি করে গেলেন সম্পদশালিনী। যে ইংরেজি ভাষার প্রতি একদিন তিনি মন্তব্য করেছিলেন- those modern languages will at one time play bankruprt with books. এই আধুনিক ভাষাগুলো একদিন গ্রন্থগুলোকে দেউলিয়া করে ছাড়বে- সেই ইংরেজি ভাষায় প্রবন্ধ সাহিত্য রচনা করে তিনি প্রবন্ধ সাহিত্যের জনক হয়ে গেলেন। ‘প্রবন্ধ’ এ শব্দটা তিনি প্রথম ব্যাবহার করেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে। কোথায় পেলেন এ শব্দটা? নিজের প্রতিভা বা ঈশ্বরের করুণায় তিনি তা লাভ করেননি। তিনি ফরাসি লেখক মঁতে ঞ-এর নিকট ঋণী। তারই রচনা থেকে তিনি শব্দটা গ্রহণ করেছিলেন। তিনিই তার গুরু। কিন্তু গুরুর কাছ থেকে শব্দটি গ্রহণ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করেননি। ভাব-ভাষা, রূপ ও রীতি তার নিজস্ব। তবে প্রবন্ধের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য তা তিনি গ্রহণ করেছেন গুরুর কাছ থেকে। প্রবন্ধের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য কি? প্রবন্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আত্মগতভাব ও ভাবনা।
প্রকৃত প্রবন্ধ আত্মগতভাব বা ভাবনায় অনুরঞ্জিত হতে বাধ্য। যেখানে সেটুকুর অভাব সেখানে নিছক তথ্য ভারাক্রান্ত বস্তুগত প্রবন্ধ হতে বাধ্য। মঁতে ঞ বলেছেন, তার রচনা consubstantial অর্থাৎ রক্ত মাংসের সমন্বয়ে সৃষ্ট। প্রবন্ধের বস্তু হচ্ছে- তার মাংস আর আত্মগতর সচেতনা হচ্ছে তার রক্ত। সুতরাং প্রবন্ধমাত্রই প্রবন্ধকারের আত্মগতভাব ভাবনা ব্যতিরেকে নয়।
বেকনের প্রবন্ধ কোন শ্রেণির? ইংরেজি সাহিত্যের জন্য যে প্রবন্ধগুলো তিনি রচনা করেছেন অর্থাৎ সাহিত্যিক প্রবন্ধগুলো আত্মগত ভাবনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু তাই বলে তার ‘ম্যাক্সিম অফ দি ল’ (maxim of the law) ‘আইনের সাধারণ নীতি-নিয়ম’ বা ‘ব্যবহারিক আইনের পাঠ’ নিঃসন্দেহে আত্মগত ভাবনায় সমৃদ্ধ নয় এগুলো নিছক বস্তুগত। তাই সে প্রবন্ধগুলো সাহিত্য গুণ সমৃদ্ধ। সেগুলোতে আপনার ধ্যান-ধারণাকেই তিনি প্রকাশ করেছেন। তার এই নিজস্ব ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠেছিল জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ ধনে।
সে অভিজ্ঞতার মধ্যে ঈশ্বরের অবদান বলে কিছু ছিল না। মনে রাখতে হবে বেকন ছিলেন একজন ঝানু অভিজাত রাজনীতিক এবং অইনজ্ঞ। সুতরাং তার ধ্যান-ধারণা ও জীবন দর্শন যে বাস্তবভিত্তির উপর গড়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। ফলে কোনো প্রচলিত সত্যকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। on truth (সত্য) প্রবন্ধে বেকন সত্যের যে স্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন সে সত্য খাদহীন খাঁটি স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল নয় তা স্বর্ণের ব্যবহারিক রূপের মতো উজ্জ্বল। কারণ A mixture of a lie both ever add pleasure. খাঁটি স্বর্ণের সঙ্গে খাদ মিশ্রিত করলে যেমন ব্যবহারিক আনন্দ দেয়, তেমনি সত্যের সঙ্গে একটু মিথ্যার খাদ মিশিয়ে নিলে তা আরো আনন্দদায়ক হয়।
তার বক্তব্যকে জোরালো করার জন্য তিনি গ্রিক পণ্ডিতদের কাব্য সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণাকে যুক্তির দ¦ারা খন্ডন করতে চেয়েছিলেন। কোন কোন গ্রিক পণ্ডিতের ধারণা সাহিত্যের মধ্যে ন্যায় বা সত্তা নেই আছে মিথ্যর কারবার। সুতরাং সাহিত্যকে সমাজ থেকে নির্বাসন দেয়া উচিত। কিন্তু বেকন মনে করেন যে সাহিত্যের মধ্যে যে মিথ্যার উপস্থাপনা থাকে তা মানব মনে কোনো দাগ কাটে না। প্রশ্ন হলো সত্যই কি সাহিত্যের মিথ্যা মানব মনে দাগ কাটে না? বেকন অবশ্য তাই বিশ্বাস করতেন বলেই সত্যের নিজস্ব রূপ মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। একজন আইনজ্ঞের কাছে অবশ্য খাদহীন সত্যের রূপমূর্তি আশা করাও বৃথা। এ অর্থে মনে হয় তিনি একজন সুবিধাবাদী। হিউ ওয়াকারের মতে - Bacons morality is prudential. The essays seem to be the work of on opportunist.’
‘সত্য সম্বন্ধে যে ধারণা সেই ধারনাই প্রকাশ করেছেন- ‘of simulation and dissimulation. প্রবন্ধে। বেকন বলেছেন- The best composition and temperature is to have openness in fame and opinion. Secrecy in habit: dissimulation in seasonable use, and a power to feign, if there be no remedy. সবচেয়ে ভালো গুণসম্পন্ন মানস প্রকৃতি হলো মতামত এবং যশ সম্বন্ধে স্পষ্ট হওয়া, অভ্যাসে গোপনীয়তা রক্ষা করা, প্রয়োজনে মিথ্যার ছলনা ত্যাগ করা এবং উপায় না থাকলে ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করা। এ ধ্যান-ধারণা কোনো মহৎ উচ্চ সমুন্নত ধ্যান-ধারণা নয়; এ হলো কুট বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান সুকৌশলী বিনয়-বুুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ধ্যান-ধারণা। আর এ বৈষয়িক ধ্যান-ধারণাই তো তার জীবনদর্শন যে তার নিজস্ব প্রকৃতি ও ধাতুতেই গড়ে উঠেছে। তিনি কৌশলকে নিন্দা করেছেন এই জন্য নয়, যে তা হলো ঘৃণ্য এবং জঘন্য জিনিস, নিন্দা কনেছেন অভিজ্ঞজনোচিত বলে। তিনি ভালো ও মন্দ দুটোরই প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছেন। of suitors’. ‘আবেদনকারী’ প্রবন্ধে বলেছেন- It affection lead a man to favoure the wrong side in justice, let him rather use his countenance to compound the matter than to carry it. If affection lead a man to favour the less worthy in deset.let him do it without depraving or disabling better deserver’
ভালোবাসা যদি ন্যায়ের ক্ষেত্রে অন্যায় পথকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়, তাহলে সে ব্যাপারে কোনো মতামত না দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে মিটিয়ে ফেলা উচিত। ভালোবাসা যদি দুর্বল পথকে, অর্থাৎ যার জেতবার কোনো আশা নেই, সমর্থন করতে বাধ্য করে তা হলে সবল পথের বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা বাদ বা দোষারোপ না করেই তা করতে হবে। বেকনের এ বক্তব্য অন্যায়কে সমর্থন করার এক অদ্ভুদ এক রণকৌশল মাত্র। বেকন কৌশলকে নিন্দা করেছেন; কিন্তু তার মত দক্ষ কৌশলী আর কে থাকতে পারে? বেকনের জীবনদর্শন ‘প্রয়োজনভিত্তিক’। প্রয়োজনের বাইরে তার কোনো মূল্য নেই। যতক্ষণ বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া যায়, ততক্ষণ বন্ধু a friend is another himself. কিন্তু বন্ধুকে প্রতিদানের ব্যাপারে একথা সত্য হয়ে উঠে কি না, সে ব্যাপারে তিনি মুখ খোলেননি।
যাই হোক প্রবন্ধগুলোর মধ্যে বেকনের সন্ধান মিললেও তার আত্মগত ভাবনার পরিচয় থাকলেও বেকন যেন যুগেরই কথা প্রকাশ করেছন। বেকনের যুগ ছিল ধুরন্ধর বৃত্তির যুগ। ধুরন্ধর বেকন ধুরন্ধর বৃত্তিকেই প্রকাশ করেছেন। সে যুগের আত্মাকেই ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেছেন। যে ধুরন্ধর বৃত্তিকে শেক্সপীয়ার ঘৃণার আলোকে তার স্বরূপকে প্রকাশ করেছেন।
বেকন ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দের এক ঝাঁক প্রবন্ধের একটি সংস্করন প্রকাশ করেছিলেন। তাতে মোট ১০টি প্রবন্ধ ছিল। পরে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে সেগুলো পরিবর্ধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন করে তার সাথে আরো ২৯টি নতুন প্রবন্ধ যোগ করে একটি সংস্করন বের করেন। পরে আবার ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে সেগুলো পুনরায় পরিবর্ধন ও পরিমার্জণ করে আরো নতুন প্রবন্ধ যোগ করে মোট ৫৮টি প্রবন্ধের সংস্করণ প্রকাশ করেন। ফলে তার রচনার আসল রূপ হারিয়ে মুছে গিয়ে একটা বিদগ্ধজনের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই জন্য তার রচনায় পরিপক্ব মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায়। বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং জোরালো, সংক্ষিপ্ত অথচ ভাবনার ব্যাপক বিস্তার; ভাষানিটোল। আঁটসাঁট, প্রয়োজনাতিরিক্ত নয়, অথচ সহজ, সরল বোধগম্য, স্বচ্ছন্দ গতিতে আছে মেপে মেপে পা ফেলার প্রবহমানতা। ভাষার এই গতিও রূপের মাঝে একটি রাজকীয় ধ্রুপদী গাম্ভীর্য আছে, প্রকাশের মধ্যে আছে পৌরুষদৃপ্ত বলিষ্ঠ ভঙ্গি এবং শক্তির সুষমা যেন ভাস্কর্যে শিল্পের কারুকার্যে খোদাই করা মূর্তির মহিমা। আর এই জন্যই বেকন হলেন ইংরেজি সাহিত্যের জগতে প্রবন্ধ সাহিত্যের কীর্তিমান জনক। বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছন সত্য, কিন্তু মৌলিক নীতিতত্ত্বের বিষয়কে তিনি সযত্নে পরিহার করে গেছেন। কারণ মহৎ উচ্চ সমুন্নত নীতিতত্ত্ব সমস্যা তার কছে আদর্শ ছিল না। তার আদর্শ ছিল- Let a man, in the choice of his mean. Rather choose the fittest mean than the greatest mean; and rather than that deal in certain things than chose that are general. (of Suitors) কোনো বিশেষ বিষয়ের প্রতি তার ছিল অনুরাগ। সেই বিশেষ বিষয়কে প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি গ্রিসের এবং রোমের প্রাচীন দার্শনিক ও রাজনীতিবিদদের বক্তব্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তার রচনার মধ্যে তাদেরই বাস্তব নিষ্ঠধ্যান-ধারণার অজস্র উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আপন বক্তব্যের সমর্থনে তাদের সাহায্য গ্রহণ করেছেন। এ থেকে তার ক্লাসিক্যাল প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়।