ঢাকা ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফানুসের আলো নয়, মানবতার আলো জ্বালাই

রাজু আহমেদ
ফানুসের আলো নয়, মানবতার আলো জ্বালাই

একবার ভাবুন তো একটা ফানুসের দাম ১৫০ টাকা। আবার ফুটপাতের একটা সোয়েটারের দামও ১৫০ টাকা। ফানুস একবারেই উড়ে যাবে, সোয়েটারটা পরিধান করা যাবে কয়েক বছর, দুইটি ফানুসের দামে মোটামুটি মানের একটা কম্বল কেনা যাবে, ব্যবহার করা যাবে ৪-৫ বছর। শহরের ছিন্নমূল শিশু, আশ্রয়হীন বৃদ্ধ কিংবা উত্তরবঙ্গের হাড় জিরজিরে মানুষের তীব্র শীতের রাতের কাঁপুনি মানুষের বিবেককে কেন কম্পিত করে না? ফানুসের টাকায় মানুষ মানবতার দেয়ালে দু’টো কাপড় রাখতে পারে না? ফানুস পোড়ানোর চেয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো অনেক দামী। এই যে থার্টি ফাস্ট নাইটে হাজার হাজার ফানুস উড়বে, তাতে অন্ধকার রাতটাতে কিছু সময় আলো ঝলমলে হবে; কিন্তু আপনি কি সেই অন্ধকার দেখেছেন? যা চোখের মধ্যে থাকে। আপনি নিশ্চয়ই সেই অন্ধকার দেখেননি। দেখলে আর ফানুস উড়ানোর মতো কাজ করতে পারতেন না। যে মানুষটি খাবার পায়নি, অর্থাভাবে যার চিকিৎসা হচ্ছে না কিংবা দরিদ্রতার কষাঘাতে যাদের শিক্ষাজীবন থমকে গেছে তাদের পাশে একটু সহানুভূতিশীল হয়ে দাঁড়ানো যেতো না? যে ভিক্ষুক আপনার সামনে হাত পেতে দু’টো পয়সা চেয়েছে তাকে ফিরিয়ে না দেয়া, নাকি ফানুস উড়ানো- মানবসভ্যতার জন্য কোনোটি জরুরি? আচ্ছা, ফানুস উড়ানোকে কাজ বলব নাকি অকাজ? থাক সেসব কথা!

ফানুস উড়িয়ে আপনি অন্ধকার রাতটাকে আলো ঝলমলে করার চেষ্টা করছেন। মাত্র এক রাতের জন্য হইহুল্লোরে রাতের অন্ধকার দূর করতে চাচ্ছেন অথচ আপনার আশপাশের কিছু মানুষের চোখে সারাজীবন অন্ধকার লেগেই থাকে। দরদের দিল নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন কখনো? ভেবেছেন তাদের অসহায়ত্বের কথা? কতো মানুষ এই শীতের রাতে রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে জমে যাচ্ছে- ঠান্ডায়, কাতর হচ্ছে ক্ষুধায়। আহারে, শহরজুড়ে মানবতা কাঁদছে! শুনতে পান? গোটা একটা প্রজন্ম আমিষহীনতায় বেড়ে উঠছে। একটা কিছু করুন! ওদের পাশে দাঁড়ান।

ফানুসটা উড়ে যাবে। কতদূর উড়বে? কতক্ষণ থাকবে? কোথায় যাবে? আপনি জানেন না। এবার না হয় ফানুসের টাকায় অথবা থার্টি ফাস্ট নাইটে অপচয় করার জন্য যে টাকা রেখেছেন, সে টাকায় কম্বল কিনে কারো বাঁচার সম্বল করে দিন। সোয়েটার অথবা কিছু খাবার কিনে দান করলেন অসহায় মানুষদের মধ্যে। ভালোমন্দ খেতে খেতে একবেলা গল্প করলেন বৃদ্ধাশ্রমের পরিবার পরিত্যক্ত বয়স্কদের সাথে কিংবা এতিমখানায় বেড়ে ওঠা অবহেলিত সন্তানদের সাথে। আপনার কাজটা পৌঁছে যাবে আসমান পার করে, টিকে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। ইহকালে পাবেন অন্তরের প্রশান্তি, পরকালে আল্লাহতায়ালা দিবেন পুরস্কার। বাদ দিন পরকালের কথা, মানসিক তৃপ্তি পাবেন- গ্যারান্টি দিচ্ছি।

একটা কম্বল নিয়ে ঘুমন্ত একজন ছিন্নবস্ত্র মানুষের পাশে গভীর রাত্রে দাঁড়ান। যদি ছবি তুলতে মন চায় তাও তুলুন তবুও মানুষকে সাহায্য করুন। এতে হয়তো আপনার কিছু পাপ মুছে যেতে পারে অথবা আপনার দিকে তেড়ে-ধেয়ে আসা কোন বিপদ থেমে যেতেও পারে। অন্ধকার রাতে ল্যাম্পপোষ্টগুলো ঠিকই জ্বলে, আলোকিত করে রাতকে। মানুষের মনে আলো জ্বালানোর দায়িত্ব নিন। মানুষের বেদনার সাথে সমব্যাথি হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও মানুষের মতো মানুষ হোন।

ফানুস উড়লে আকাশটা আলোকিত হতো। চলুন না, এবার আলোকিত করি মাটিটাকে। কারো জীবনের ঘোর অন্ধকারে একবার না হয় ল্যাম্পপোষ্ট হই। মানবজীবনে এই কাজ শুধু একবার করুন। কথা দিচ্ছি, জীবনে বারবার এমন করতে ইচ্ছা করবে। অন্তত ফানুস পোড়ানোর মত কাজ-অকাজে পয়সা এবং সময় নষ্ট করার অরুচি দূর হবে। আসমানের নিচে আর মাটির উপরে এর চেয়ে মহৎ কর্ম আর একটাও নেই।

আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা। রাতগুলো পাখিদের-পোকাদের এবং পশুদের। নিরাপদে ও নিরাপত্তায় বাঁচার অধিকার ওদেরও আছে। বিকট শব্দে, অযাচিত আলোতে পশুপাখিদের ভীতসন্ত্রস্ত করলে মানুষের পাপ বাড়বে। জন্তু-জানোয়ার অন্যান্যদের জন্তু-জানোয়ারসুলভ আচরণ থেকে রক্ষা করা জরুরি। পশুপাখিদের নিশ্চিতে ও নির্বিঘ্নে থাকতে ও বাঁচতে দেয়া জরুরি। পশু-পাখিদের অভিশাপ ভয়ঙ্কর। স্রষ্টা সবার আগে ওদের কথাই শোনেন।

তাছাড়াও ফানুস উড়ানোর নামে প্রতিবছর অসংখ্য অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। পুড়ে যায় মানুষের জীবন ও স্বপ্ন। ধ্বংস হয় সম্পদ। ফানুস উড়ানোর মতো এমন বিধ্বংসী কাজে বিবেকবানদের অংশগ্রহণ থাকা অনুচিত।

যেটা অপচয় এবং যে কাজের দ্বারা নিরাপত্তা হুমকিগ্রস্ত হয়, সে কাজ থেকে সচেতন ও শিক্ষিত প্রজন্মের ফিরে থাকা উচিত। সেই জাতিকে ইতিহাসের পাতায় সম্মানিত করে রাখা হয়, যাদের অতীতের আমলনামা সৎকাজ রেখে আসে। ফানুস উড্ডয়ন কোনো বিচারেই ভালোকাজ নয়। এর মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেকপ্রসূত ভাবনার একটুখানিও উপস্থিতি নেই। আগামীকালের আগেই ভাবুন এবং মানুষ থাকার সিদ্ধান্ত নিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত