পৌষের ধূসর কুয়াশার হালকা চাদর ছড়িয়ে রক্তিম সূর্য জানান দিচ্ছে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের আবির্ভাব। পুরনো বছর পেরিয়ে নতুন বছরের শুরুতে হাজারো নবপ্রত্যাশার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। বিদায়ী বছরটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুব সুখকর সময় ছিল না। অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং ব্যাপকভাবে আলোচিত ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ ব্যাপক অর্জন ও অনেক শঙ্কা পেরিয়ে বিদায় নিল। পরশ্রীকাতরতার অনলে দগ্ধ হয়ে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। তিনিসহ গ্রামীণ টেলিকমের আরো তিনজনকে ঢাকার শ্রম আদালত ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে এবং পরবর্তীতে নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে মামলার কার্যক্রম ৮ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বাতিল করে।
বছরের প্রথম দিকে প্রাকৃতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে দুর্যোগের ধারা অব্যাহত ছিল। বিগত বছরটি মূল্যস্ফীতির কারণেও বাংলাদেশের মানুষের জন্য কষ্টকর ছিল। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.২৭ শতাংশ। এর ফলে নির্দিষ্ট আয়ের জনগণ খুব কষ্টের মধ্যে ছিল। নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দাম দেড় গুণ থেকে দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া দরিদ্র লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে গিয়েছিল, তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে। ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে বহুমানুষ পঙ্গত্ত্ব বরণ করেছে। রাজনীতিতে মানুষের ভোটাধিকার সংরক্ষণের দাবি অত্যন্ত প্রবল হয়েছে। বিগত সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন বিস্ফোরিত হয়ে উঠছে। ভোটাধিকারের প্রয়োগ বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি আবেগ মিশ্রিত অধিকার। এদেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। কিন্তু রাজনৈতিক সহনশীল না হওয়ায় বিগত সরকার ২০১৪ এবং ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সর্বশেষ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের উপর বেজায় নাখোশ হয়ে যায়। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রত্যাখান সত্ত্বেও গৃহপালিত জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ একতরফা ও ড্যামি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিল। যার প্রভাবে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনেও অনেক ক্লেদ জমে উঠেছিল। যার বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার উপর। বড় বড় মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো আগের তুলনায় মজবুত হয়েছে কিন্তু মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বগুণ সঞ্চারিত না হওয়ায় এসব চোখ ধাঁধানো অবকাঠামো দেশের কোনো কাজে আসছে না। প্রতিদিনের অপরাধচিত্র বলে দেয় মানুষের মনুষ্যত্বহীনতার কথা। আবশ্যক সুশাসনের অভাবের কথা। ইদুল আজহার কোরবানির জন্য বিটল প্রজাতির ছাগল নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তার ছেলের বিটলামি ও সেই কর্মকর্তা ছেলেকে অস্বীকার করার মধ্যদিয়ে দেশে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তা আমাদের মতো সাধারণ জনগণকে বুঝিয়ে দেয় দেশের সেবার আড়ালে কর্তাবাবুরা কতটা দুর্নীতিবাজ। চাকরি প্রার্থীদের কাছে পিএসসি ছিল বিশ্বাসের জায়গা গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে সৈয়দ আবেদ আলী নামক পিএসসি চেয়ারম্যানের এক ড্রাইভার। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি প্রকাশ ও দুদক কর্তৃক সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় তার সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত হয়। লোভী রাজনীতির অপচ্ছায়ার কারণে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আশাজাগানিয়া কোনো খবর ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির সহযাত্রী যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজের সর্বত্র দীনতা প্রকাশিত হচ্ছে। সামান্য মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানষিক প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন তোফাজ্জল হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হক হলে পিটিয়ে হত্যা করেছে। সংবিধানের ৭(১) ধারা জনগণকে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে তা অকার্যকর। কায়দা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার আর ফন্দি-ফিকির করে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টায় রত থাকাটাই ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মূল এজেন্ডা। সেই কারণে রাজনীতি নয় দৃশ্যমান ছিল ক্ষমতানীতি এবং তাতে জনগণ ছিল অবিবেচ্য। ফলাফল হিসেবে কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে জুলাই বিপ্লব এবং একগুঁয়েমী ও ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আজকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। চমক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ। ১৯৮ জন বিশ্ব নেতার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন যেমন দেশের জন্য ছিল স্বস্তির ঠিক তেমনি বিরক্তিকর বিষয় ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মিডিয়ায় মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা প্রচার। পুরো বছর জুড়েই শিক্ষা খাত ছিল অস্থির। নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে শিক্ষক ও অভিভাবক মহলের আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন নিয়ে আন্দোলন এবং সাবেক প্রধান মন্ত্রীর ব্যাঙ্গাত্নক মন্তব্যের বিরোধিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টানা কর্মবিরতি। আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যার প্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা। বিতর্কিত শরীফার গল্প নিয়ে দেশজুড়ে সচেতন মহলের আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্ট সংকট এবং পরবর্তীতে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল প্রদান ক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা বোর্ডসমূহ ভাঙচুর। জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে নতুন প্রণীত শিক্ষাক্রম অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কর্তৃক বাতিল ঘোষণা করা হয়। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মব জাস্টিসের উত্থান ঘটে। শিক্ষাঙ্গন গুলোতে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও জোরকরে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের উগ্রবাদী নেতা চিন্ময় কুমার দাস জাতীয় পতাকা অবমাননার দায়ে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় গ্রেফতার হলে গত ২৬ নভেম্বর চিন্ময়ের অনুসারীরা চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণের বিপরীত দিকে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে শিক্ষার্থী নিহত হয়। নিকট অতীতের কর্মকাণ্ডের ভয়ে পুলিশ কর্মবিরতি ঘোষণা করলে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক পলিথিন পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন এবং শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে এখনো কমিশন গঠন না হওয়ায় দেশব্যাপী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমালোচিত হয়। উচ্চ আদালত কর্তৃক ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় কিন্তু চালকদের আন্দোলনের মুখে সরকার চালানোর অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট কর্তৃক বাংলাদেশ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয়। সর্বশেষ সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ। নিয়মের পরিক্রমায় এসেছে নতুন বর্ষ ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ। নতুন বর্ষে আমরা যেন বুদ্ধিহীন, বিবেকহীন, সুচিন্তাহীন হয়ে না পড়ি। তার জন্যই বছরের শুরুতে আমাদের প্রত্যাশা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার উপযোগী রাষ্ট্রকাঠামো ও পরিবেশ যেন সৃষ্টি হয়। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে। বিশ্ব নেতৃত্বের উপযোগী হয়ে যেন আমাদের সন্তানেরা বেড়ে উঠতে পারে সেই লক্ষ্যে ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষক সমাজের জীবন মানের উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে। দেশের শিক্ষার আমূল পরিবর্তনের জন্য পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসা অত্যাবশ্যক। ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সঙ্গে আমাদের দেনা-পাওনার হিসেব গুলোও সঠিকভাবে করতে হবে। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা লাভের জন্য বাংলাদেশকে অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি পরামর্শ দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব তৈরিতে দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালান এবং শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে। যাতে করে রাজনীতিতে শক্তির দাপট, ক্ষমতার দাপট, অর্থের দাপট, অমুকপন্থি-তমুকপন্থির অসুস্থ দলবাজি, চামচামি-দালালি, তেলবাজি ও ‘ব্যক্তি-পূজা’র সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কোনো গণতন্ত্রবেশী স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদী, দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী বাংলাদেশের মসনদে জেঁকে বসুক তা বাংলার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ আর চায় না। তাই নতুন বর্ষের শুরুতেই অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রতি প্রত্যাশা দেশের মানুষ যেন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে দ্বারা একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার উপহার লাভ করে। বাংলাদেশের মানুষ একটি সবুজ-সতেজ জীবনীশক্তি নিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসুক। বাঙালি-অবাঙালি, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী-বৃহৎনৃগোষ্ঠী, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, ইহুদি-নাসারা, জৈন-শিখ, মুচি-মেথর, চামার-চন্ডাল, পৌত্তলিক-নিরাকারবাদী, নিরীশ্বরবাদী-বহুঈশ্বরবাদী, আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক আমাদের সোনার বাংলা।
লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা