২০২৪-এর ৫ আগস্ট, দীর্ঘ পনের বছরের অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার যবনিকাপাতের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার বিপ্লব, যেমন বাংলাদেশ উপহার দিল তা নিঃসন্দেহে আগেকার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। বলা সমীচীন বিপ্লবী ও বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের। তরুণ-যুবা থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মধ্যে যে নবজাগরণ ও রাজনৈতিক সচেতনতার উন্মেষ ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে অভিনব ও অভূতপূর্ব। পরিবর্তিত এই বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতি কিংবা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বিশেষকরে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্রদলে’র বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলার উপযুক্ত সময় বোধহয় এখনই।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী চিন্তা ও রাষ্ট্র দর্শনের উপর ভিত্তি করেই ছাত্রদলের অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শেখ মুজিবের দানবীয় শাসনতন্ত্রের অবসান হলে নতুন রাষ্ট্র গঠন ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা। শেখ মুজিবের বাকশালী বন্দোবস্তের বিপরীতে তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করে, সকল মত ও পথকে সমুন্নত করে এক শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেন। বাংলাদেশকে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবয়ব দান করতে গঠন করেন জাগদল এবং পরে এই জাগদলকে ১৯৭৮ সালের ২৮ আগস্ট বিএনপির সঙ্গে একীভূত করেন। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি, বিএনপির জন্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির প্রয়োজনীয়তা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সৎ, যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির অন্তর্ভুক্তির কথা বিবেচনা করে জিয়াউর রহমান ‘ছাত্রদল’ গঠন করেন।
শহীদ জিয়া অনুধাবন করেছিলেন আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে বাংলাদেশকে সম্মুখ ভাগে রেখে দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য এমন এক রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি করতে হবে, যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভ্রান্ত মতবাদকে খারিজ করে সাম্য ও ঐক্য বা মৈত্রীর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনকে রাষ্ট্র পরিচালনার অনুপ্রেরণা হিসেবে লালন করবে। ভারতের আধিপত্যবাদ মুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
আজকের ছাত্রদলের অনেকেই হয়তো জানেন না জিয়াউর রহমান ছাত্রদলকে রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত ও চৌকস জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত ক্লাস নিতেন। প্রতিটি ক্লাসে জিয়াউর রহমান তার রাজনৈতিক দর্শন, উন্নয়ন চিন্তা, রাষ্ট্র ভাবনা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালচিত্র, বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়ে ছাত্রদলের নেতাদের অবহিত করতেন এবং হাতে কলমে তাদের করণীয় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করতেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছাত্রদলকে দেশ গঠনে ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯ দফার একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন যা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মপন্থার ভৌত ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিএনপির ভ্যানগার্ড জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলের পুরোটা সময় জুড়েই ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ছাত্রদলের উপর চালিয়েছে অকথ্য নির্যাতন। তাদের জন্য স্বাভাবিক রাজনীতির পথ ছিল সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ। তবে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। হাসিনার মাফিয়া সরকারের পতন ছাত্রদলের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পরিবর্তিত বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করার অবারিত সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সাম্যের দর্শনকে মূল উপজীব্য করে নতুন ধারার রাজনীতি করার যে রোডম্যাপ ছাত্রদল প্রকাশ করেছে তা বাস্তবায়ন করাটাই হবে তাদের পরিবর্তিত বাংলাদেশে রাজনীতি করার প্রধানতম অঙ্গীকার। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও তারেক রহমানের ৩১ দফাকে ধারণ করে শিক্ষা ও জনবান্ধব রাজনীতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটাই হবে ছাত্রদলের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে নিজেদের অভিযোজন ঘটানো এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে ছাত্রদল পুনরায় দেশ ও দশের কাছে আস্থা এবং বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত হতে পারে। জ্ঞান নির্ভর সমাজ বিনির্মাণে ছাত্রদল হতে পারে অন্যতম কাণ্ডারী। আশাহত কৃষক-শ্রমিক ও ছিন্নমূল মানুষের দিশারী।
ফ্যাসিবাদ মুক্ত পরিবর্তিত বাংলাদেশে ছাত্রদলের রাজনীতি কতটা শিক্ষা ও গবেষণাবান্ধব হবে তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের উপর। ছাত্রদল কি শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করে সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে, না চিরাচরিত রীতিনীতির ফাঁদে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে! নিশ্চয়ই ছাত্রদল বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ ও জন প্রত্যাশার সব ফয়সালা নিয়ে হাজির হবে।
লেখকদ্বয় : তথ্যবিদ ও গবষেক