ছোটবেলা থেকেই মাতৃভূমিকে ভালোবাসি। মাতৃভূমিকে ভালোবেসে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। একজন আদর্শবান মানুষ তথা একজন স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হওয়ার অভিপ্রায়ে পথ চলছি, থেমে যাইনি। বই পড়ব, মানবে প্রেম করবো, দেশের কল্যাণে কাজ করবো, এইতো জীবনের অঙ্গীকার। প্রথমত, বই পড়া, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বইয়ের মধ্যে মজে থাকা, পড়ুয়া হওয়া, দ্বিতীয়ত, মানুষকে ভালোবাসা, তৃতীয়ত, মানুষের কল্যাণে কাজ করা এবং একজন সফল রাজনীতিবিদ হওয়া। জীবন চলছে। আটান্ন বছরে পা দিয়ে ভাবছি, প্রথমটায় সফল হইনি, দ্বিতীয়টায় কি সফল হতে পারবো? পড়ুয়া হতে পারিনি, সংখ্যাধিক্যের প্রতি প্রেমে মন ধরে রাখতে পারিনি, জ্ঞানীও হইনি, প্রেমিকও হইনি। মানুষকে ভালোবাসি, অথচ প্রতিনিয়ত মানুষের কাছ থেকেই আঘাত পাই, পাচ্ছি। আকৃতিতে মানুষ দেখি, ভিতরে মনুষ্যত্ব খুঁজে পাই না। মানুষ বলতে আমার যা ধারণা, তা পাল্টে গেছে। দৃশ্যত দেখছি, বর্তমান সময়ে মানুষের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছে। কার্যত, আমার বুঝ-জ্ঞানটা অনেকের থেকে আলাদা হয়ে গেছে! বেদনাদায়ক। অধ্যাপক রেহমান সোবহান লিখিত ২০২১ সালে প্রকাশিত তার আত্মস্মৃতির দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, ‘দিস ফেইজ বিগান ইন হোপ বাট এন্ডেড ইন ডার্কনেস’- শুরু হয়েছিল আশা নিয়ে, শেষ হয়েছে অন্ধকার আর হতাশা দিয়ে। বইটির ইংরেজিতে নাম ‘আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশনস: নেশন বিল্ডিং ইন পোস্ট-লিবারেশন বাংলাদেশ’। বইয়ের ভূমিকায় অধ্যাপক সোবহান আমাদের জানিয়ে দেন যে, এটি তার তিন খণ্ডে রচিত স্মৃতিকথার দ্বিতীয় খণ্ড। প্রথম খণ্ডটি আগেই প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম ছিল ‘আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশনস: দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট’। প্রথম খণ্ডের কালপর্ব অধ্যাপক সোবহানের জন্মকাল থেকে ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মকাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত, যেখানে বিবৃত হয়েছে অধ্যাপক সোবহানের বেড়ে ওঠার কাহিনি। যৌবনে ‘দুই অর্থনীতি’ সম্পর্কে তার চিন্তা-ভাবনা, ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি ও তার সতীর্থদের মিথস্ক্রিয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের বীক্ষণ এবং গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার বিবরণ। প্রথম খণ্ডের ধারাবাহিকতায় রচিত হয়েছে দ্বিতীয় খণ্ড, যার কালপর্ব হচ্ছে ১৯৭২-৭৫। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম তিন বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল।
স্যারের স্মৃতিকথার প্রথম খণ্ডে স্যার জীবনের সেই যাত্রার কথা বর্ণনা করেছেন, যেখানে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন। এই দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন জাতি গঠনের চ্যালেঞ্জগুলো এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ও ফলাফলগুলো। বইটি পড়ার নিয়ত করেছিলাম। বই পড়তে আমার খুব আগ্রহ, কিন্তু বই পড়তে পারি না। আমার অসুবিধে হলো, বই পড়তে গিয়ে বইয়ের মুখবন্ধ এবং ভূমিকা পড়া শেষ হতেই মনে আমার চলে আসে অগনিত কথা-অসীম চিন্তা, আমি কল্পনার জগতে চলে যাই। কল্পনার জগতে মশগুল হয়ে আমি আর বইয়ে ফিরে আসতে পারি না। এই বইটি পড়ার ইচ্ছা নিয়েও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। লেখক প্রথম অধ্যায়েই জানিয়ে দেন, ‘দিস ফেইজ বিগান ইন হোপ বাট এন্ডেড ইন ডার্কনেস’- শুরু হয়েছিল আশা নিয়ে, শেষ হয়েছে অন্ধকার আর হতাশা দিয়ে। আর এই লাইন পড়েই আমি কল্পনার জগতে চলে যাই। আমার কল্পনায় আসে, ৭৫-এর পর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাঙালির যত কিছু আশা নিয়ে শুরু করেছে, কোনো কিছু কি আলো দিয়ে শেষ হয়েছে! ৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনার পর ২০২৪ পর্যন্ত শাসনব্যবস্থায় অনেকগুলো পরিবর্তন হয়েছে, সবগুলোর বিশ্লেষণ যদি আমরা করি, তাহলে কি পাই, সর্বশেষ এবছর ৫ আগস্ট বিয়োগান্তক ঘটনায় উল্লাস করা মানুষগুলো যে আশা করেছিলো বা যে স্বপ্ন দেখেছিল, তারা কি এখন সেই আশায় আলো দেখতে পারছে, মাথায় এমনসব ঘুরপাক শুরু করে দিলো, আরো কত কি ভাবনা, কেমন আমরা, আমাদের মূল্যায়নে আমরা আমাদেরকে কি বলবো, আমাদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার ছেলের (বড় সন্তান) কথাটা খুব মনে পড়ছে। ১৭-১৮ আগস্ট ছেলের সাথে বাঙালির স্বভাব চরিত্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হচ্ছিলো, ছেলে আমাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বললো, বাংলাদেশের মানুষ অতি আবেগপ্রবণ, অস্থির, পরশ্রীকাতর, প্রতিহিংসাপরায়ণ। তখন আমিও বলেছিলাম, আসলে খুবই ঈর্ষাপরায়ন আমরা, এতোসব কল্পনায় মজে গিয়ে বইটি পড়ায় আর মন থাকলো না।
লেখক : আইনজীবী, কলাম লেখক।