কবি যে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলেছেন তা আমরা এ কবিতার পরবর্তী লাইনগুলো থেকে সহজেই বুঝতে পারি। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন দরিদ্রতা তাকে সত্য বলার সাহস যুগিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলেছে। এটি চিরন্তন সত্য হলেও দরিদ্রতা থেকে চিরকালই মানুষ মুক্তি চায়। পৃথিবীর সকল পিতামাতাই কামনা করেন- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। তাছাড়া দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। তারা বৈচিত্র্যহীন এই জীবন থেকে কোনো আনন্দ খুঁজে পায় না। দরিদ্রতার সাথে থাকে ক্ষুধার সম্পর্ক। তখন আকাশের সুন্দর গোলকার চাঁদটাকেও মনে হয় ঝলসানো রুটি। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাই লিখেছেন- ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি...’।
কথায় বলে, ‘অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢোকে, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।’ শুধু তাই নয়, দরিদ্রতা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে যেমন নিঃশেষিত করে দেয় তেমনি পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ তথা রাষ্ট্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাংসারিক কলহসহ বিবাহ-বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও দরিদ্রতার কারণে ঘটে থাকে। তাই দরিদ্রতার কারণ উদ্ঘাটন করে এটি দূরীকরণের লক্ষ্যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বদা কাজ করে যাওয়া উচিত। এখানে গ্রামীণ দরিদ্রতার কতিপয় কারণ তুলে ধরে তা দূরীকরণের কিছু উপায় সম্পর্কে জনমনের কিছু মতামত অবগত করা হলো। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। সঙ্গত কারণেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা গ্রামেই বেশি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অগ্রগতি হলেও কিছু প্রান্তিক মানুষের জীবনমান বা তাদের নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। ফলে বহু মানুষ দরিদ্রতার কষাঘাত থেকে মুক্তি লাভ করেনি এবং বহুসংখক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছেন। আর এ ধরনের মানুষের অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর এই পশ্চাৎপদতার বা দরিদ্রতার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।
গ্রামীণ দরিদ্রতার অন্যতম কারণ হলো- পারিবারিকসূত্রতা। অর্থাৎ তারা পূর্বপুরুষদের দরিদ্রতা যুগযুগ ধরে বংশ পরম্পরায় বহন করে চলছে। এটা একটি চক্র। এই চক্রের জাল থেকে বের হয়ে আসা কঠিনও বটে। আমরা যারা গ্রামীণ জীবনযাত্রার সাথে মিশে আছি, তারা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে, যুগের পর যুগ ধরে গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ তাদের বাপ-দাদার দিনমজুর পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এর প্রধান কারণ তারা সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি কখনোই সিরিয়াস হয়নি। একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো সুযোগ তৈরির চাবিকাঠি, আর এর মাধ্যমেই আপনি দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু গ্রামের বহু দরিদ্র পরিবার শিক্ষার দিকে খুব একটা ঝুঁকে পড়েনি। ফলে বংশানুক্রমিকভাবে তাদের সন্তানরা অল্প বয়স থেকেই পূর্বপুরুষদের কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতে করতে সেটাই নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সঙ্গত কারণেই তারা দরিদ্রতার এই কঠিন চক্র ছিন্ন করতে সক্ষম হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে গ্রামের অতি দরিদ্র পরিবার থেকেও কিছু ছেলেমেয়ে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হয়ে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ পড়ে রয়েছে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে। বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে বন্যা, নদীভাঙন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীর নাব্যতা সংকট, বর্ষাকালে কর্মহীনতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, ক্রমাগত কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস ও কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া বা বন্যায় ভেসে যায়, ফসলের ন্যায্য মূল্য না-পাওয়া, সকল গ্রামে বৈদ্যুতিক সুবিধা না-থাকা, গবাদিপশু পালনে অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধি বা রোগবালাইতে মৃত্যু হওয়া, অধিকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের কাজ কমে যাওয়া, সচ্ছল বা শিক্ষিত লোকদের শহরে বসবাস করার প্রবণতা, ব্যবসায় লোকসান, জুয়াখেলা, কর্মবিমুখ মনোভাব বা অলসতা, সংসারে কলহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ, আয় বুঝে ব্যয় না-করা, বৃদ্ধাবস্থায় বাবা-মাকে বোঝা মনে করে তাদের ত্যাগ করা। নানারকম ঋণে জর্জরিত হওয়া বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের সুদে-কারবারিদের জালে জড়িয়ে পড়া, অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব বরণ অথবা পরিবারের কোনো সদস্যের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া, ছেলে সন্তানের আশায় অধিক সন্তান জন্মদান, ভাগ্য উন্নয়নের আশায় বিদেশে যাওয়ার লক্ষ্যে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলা বা কোনো রকমে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে অবৈধতার জন্য সেখানে আটকে পড়াসহ নানাবিধ কারণে গ্রামীণ দরিদ্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান।
এ প্রসঙ্গে প্রজা হিতৈষী বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি জমিদারি দেখাশোনার জন্য একসময় নিয়মিত বাংলাদেশে আসতেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসর জমিদারি দেখভাল করতেন খুবই আন্তরিকভাবে। এ জন্য তিনি সেখানে যাতায়াত করতেন, ঘুরে ঘুরে দেখতেন। তিনি ভালো করে খেয়াল করলেন প্রতিসরের জমিদারির আওতাভক্ত কৃষকরা তুলনামূলকভাবে দরিদ্র এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বেদনাদায়ক। রবীন্দ্রনাথ দেখে কষ্ট অনুভব করলেন। তিনি বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন এবং তার নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। তারপর কর্মচারীদের এরকম নির্দেশ দিলেন যে, কৃষকরা যখন এই টাকা ফেরত দিতে পারবে তখন দিবে। না-দিতে পারলে তাগাদা দেয়ার দরকার নেই। গবেষকদের মতে, সেই টাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে কখনোই ফেরত যায়নি। অর্থাৎ ওই কৃষকদের পক্ষে কবিগুরুর দেনা শোধ করার মতো আর্থিক সচ্ছলতা কখনোই হয়নি। তারপর আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার অনেক পরে একবার কৃষক তথা গ্রামীণ দরিদ্রতার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ মওকুফ করার ঘটনা। এরপরও আমরা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে এসেছি। গ্রামীণ দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, করছেন। কয়েক বছর আগে দেশের কিছু কিছু জেলায় ভিক্ষুক মুক্ত করার লক্ষ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের একদিনের বেতন অনুদান হিসেবে নিয়ে তালিকাভুক্ত ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগও দেখা গেছে। তাতে কিছু ভিক্ষুক দোকান করে কিংবা গবাদিপশু পালন করে ভিক্ষাবৃত্তির মতো অপমানজনক জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল। জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১৭ অক্টোবর দিবসটি পালন করা হয়। দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও মানুষের মাঝে অসমতা দূর করাই এর মূল লক্ষ্য। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। নানারকম কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও আশানুরূপভাবে দরিদ্রতার কষাঘাত থেকে রেহাই পায়নি গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো। এজন্য প্রয়োজন গ্রামের প্রতিটি পরিবারে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেওয়া, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা। এছাড়া কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, কৃষি কাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার আরো বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, কৃষকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। নদীভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। দিনমজুর পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা যখন কর্মহীন হয়ে পড়ে তখন তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান করতে হবে। জুয়াখেলা বন্ধসহ গ্রামের সুদে কারবারিদের উচ্চ হারে সুদণ্ডব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। সরকারিভাবে কৃষকদের জন্য নামেমাত্র মুনাফায় অতি সহজেই কৃষি ঋণ প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা যেভাবেই যা করুক না কেন দরিদ্রতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রথমে নিজ পরিবার থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে নিজেদের নিকটজনের অভাব ঘোচানোর জন্য সাহায্য, সহযোগিতা, পরামর্শ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। পারিবারিক ও সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে হবে। নারীদের হাঁস-মুরগি পালন ও বাড়ির পাশের পড়ে থাকা জমিতে বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষে উৎসাহিত করতে হবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের পিছিয়ে থাকা প্রতিটি মানুষকে দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে সুখী পরিবার গঠনের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা। তাহলেই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কবি ও কলামিস্ট