ঢাকা ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রশাসনে বৈষম্যবিরোধী ক্যাডার আন্দোলন সচিবালয় অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে নয় তো!

সুমন দত্ত
প্রশাসনে বৈষম্যবিরোধী ক্যাডার আন্দোলন সচিবালয় অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে নয় তো!

অন্তর্বর্তী সরকারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আজ নানা কিছু ঘটছে। তবে কোনো কিছুই নতুন না। তারপরও লোকজন এসব ঘটনাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। সম্প্রতি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে আগুণ লাগে। এতে সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের ঘোষণা হয়। পরে সরকার বাতিল হয়নি বলে প্রচার চালায়। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেখে যে কারো মনে হতে পারে সাংবাদিকরাই বুঝি সচিবালয়ে আগুন লাগিয়েছে, কিংবা আগুন লাগার সঙ্গে সাংবাদিকরা জড়িত। তা না হলে সচিবালয়ে কর্মকর্তা কর্মচারী প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আসলো না। আসলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে! যেখানে সারাদিনে বড় জোর ৬০ থেকে ৭০ জন সাংবাদিক (ক্যামেরাম্যানসহ) গড়পড়তায় উপস্থিত থাকে। আমার এই কথা শুনে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, হাজারের উপর পিআইডি কার্ড ইস্যু করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। যায় মাত্র ৬০ থেকে ৭০! কীভাবে সম্ভব? হ্যাঁ এটাই সত্যি।

বাংলাদেশে সচিবালয়ে বিগত চার বছর যাবত যাওয়া আসার অভিজ্ঞতা এটি। সচিবালয়ের সাংবাদিক পরিচয়ে পিআইডি কার্ড নিলেও বেশিরভাগ নিয়মিত যাওয়া আসা করে না। তারা অন্য কারণে সচিবালয়ে যায়। কি কারণে যায়, সেটা তারাই ভালো বলতে পারে।

সাংবাদিক সমাজে প্রচার আছে কতিপয় সাংবাদিক পিআইডি কার্ডের অন্তরালে ধান্দাবাজি করে। মূলত ওই দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকদের কারণেই আজকের এই অবস্থা। যারা সত্যিকার অর্থে সচিবালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যান, তাদের ওপর আরোপ করা হলো নিষেধাজ্ঞা। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো। এদিকে সচিবালয়ের আগুন দেশের রাজনীতিতেও লেগেছে। বিএনপি ভূত দেখার মতো সচিবালয়েও আওয়ামী লীগের ভূত দেখছে। ড. ইউনূস সরকারের চার মাস অতিবাহিত। তারপরও বিএনপি জামায়েতের লোকজন ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী প্রশাসনের সব জায়গায় আওয়ামী লীগের ভূত দেখছে। অন্যদিকে গর্তে লুকানো আওয়ামী লীগ ভাবছে ফিল্ডে তারা নেই।

তাদের হয়ে কোন ভূত এসব করছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন ভুতের রাজত্ব চলছে। কেউ কোনো ঘটনা ঘটিয়ে গেলে একেক জন একেক ভূতের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। বাস্তবতার সঙ্গে কেউ পরিচিত হতে চায় না। সচিবালয়ে আগুনের তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়েছে বৈদ্যুতিক তারের লুজ কানেকশন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। পাশাপাশি আরো বলা হয় অগ্নিকাণ্ডে কোনো সরকারি নথি পুড়ে যায়নি। সবকিছু ঠিক আছে। ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সচিবালয়ে আগুন লাগে। এর আগে সেখানকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? সেটা নিয়ে কেউ ভাবে না। সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দিলে এই ক্ষোভের জন্ম দেয়। ওই দুই মন্ত্রণালয়ের লোকজন সচিবালয়ের বাইরে ও ভেতরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এতে সচিবালয়ের কাজকর্ম অচল হয়ে পড়ে। সেখান থেকে নজর ঘোরাতেই মহল বিশেষ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। সচিবালয়ে দাবি উঠেছিল যার যার মন্ত্রণালয় সেই সেই মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার সার্ভিসরা পরিচালনা করবে। অন্য মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। তাদের এই দাবি ন্যায্য ও যৌক্তিক। অথচ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এসব দাবি মানতে নারাজ। তারা জনপ্রশাসনের লোক দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় চালাতে চান। তাদের ক্ষমতার দাপট প্রতিষ্ঠিত করতে চান। যা বৈষম্যমূলক হিসেবে ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে। প্রশাসনে এর আগে ছিল ক্যাডার-নন ক্যাডার বৈষম্য। এবার ক্যাডারদের ভেতর বৈষম্য শুরু হয়। এখন জনপ্রশাসনের ক্যাডারদের দাপটে বিষয়ভিত্তিক মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার সার্ভিসরা দ্বিতীয় শ্রেণির ক্যাডারে পরিণত হোন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারদের সুযোগ-সুবিধা সীমিত করে দেয়া হয়েছিল অনেক আগেই। অথচ একই প্রশ্নেপত্রে পরীক্ষা দিয়ে তারা সবাই বিসিএস ক্যাডার হোন। দীর্ঘদিনের এই বৈষম্য আরো বৃদ্ধি করে অন্তর্বর্তী সরকারের গড়া সংস্কার কমিশন। তারা প্রস্তাব দেয় এবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে বিলুপ্ত করার। যা ওই দুই ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ক্ষোভে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। সচিবালয়ে এসব দেখে অনেকে মন্তব্য করেন ইউনূসকে সচিবরাই টেনে নামাবেন। এখন সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে সেটাকে ধামাচাপা দেয়া মহল বিশেষের উদ্দেশ্য বলেই লোকজন বলাবলি করছে।

কতদিন প্রধান উপদেষ্টার সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ক্যাডারদের ক্ষোভের আগুন দমিয়ে রাখতে পারে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। সম্প্রতি জনপ্রশাসন থেকে আন্দোলনরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে থেকে এভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ করা যায় না। যা আচরণ বিধি লঙ্ঘনের সামিল। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যেকোনো উদ্যোগ প্রস্তাব মাত্র। এটি কার্যকর এখনো হয় নেই। সে কারণে এসব থেকে দূরত্ব বজায় থাকার অনুরোধ জানানো হয়, আন্দোলনরত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।

লেখক : সাংবাদিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত