ঢাকা ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিলুপ্তির পথে আদিম মানবজাতি

আফতাব চৌধুরী প্রকাশ
বিলুপ্তির পথে আদিম মানবজাতি

জারোয়া, ওঙ্গে, সেন্টিনিলিস, গ্রেট আন্দামানি। এরাই প্রথম আদিম সভ্য মানবজাতি। সভ্যতার ‘সর্বনাশে’ ওরা আজ বিলুপ্তির পথে। নৃ-তত্ত্ববিদরা মনে করেন, লক্ষ বছর পূর্বে এই আদিম মানবজাতির পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে ভৌগোলিক কারণেই সমুদ্রপথ বেয়ে চলে এসেছিল ভারতের শেষ ভূখণ্ড-আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বৃষ্টিস্নাত চিরসবুজ অরণ্যে। আমাজন অরণ্যের মতোই লক্ষ বছর ধরে পান্নারঙের সমুদ্রজলবেষ্টিত দ্বীপপুঞ্জের কোলে আকাশচুম্বী বৃক্ষরাশির অরণ্যে। রুপোলি বালুকাবেলার নিষ্পাপ সৈকত এর অলংকার।

সবুজ জলরাশি, নানা রঙের প্রবালদ্বীপ ছাড়ালেই আদিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ আর সমুদ্রের মধ্যে ফারাক করাই দুরূহ। তারপর ‘কালাপানি’। ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রথমে অতলান্ত সমুদ্র পার করায় সাধারণ অপরাধীদের, তারপর দেশপ্রেমিক স্বদেশীদের। এই দ্বীপান্তর করানোর পরই শুরু হয় সভ্য মানুষের বসতি। বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠল তখন থেকেই। আজ সভ্যতার গ্রাসে বিলুপ্তির পথে সেই আদিম মানবজাতিই। অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন। আজ আর কালাপানির দ্বীপান্তর নয়।

সহজলভ্য জমি, দুর্মূল্য বনানীর আকর্ষণ আধুনিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটাচ্ছে। এই রোমান্টিক ‘সবুজ দ্বীপ’ এখন ট্রাইবাল ট্যুরিজমের আকর্ষণের কেন্দ্র। ক্রমেই কোণঠাসা সেসব আদিম মানুষ। উন্নয়ন, যোজনা, প্রগতি এখানে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। অনুন্নত এলাকার উন্নয়নের সঙ্গে এই আদিম প্রস্তরযুগের মানুষের অধিবাসকে একই দৃষ্টিতে দেখার বিপদ দগদগে ঘার মতো প্রস্ফুটিত।

তিল তিল করে মানবজাতির বিবর্তন-ইতিহাসের ‘অপমৃত্যু ঘটছে তথাকথিত সভ্য মানুষের হাতেই। আন্দামানের জারোয়াদের পূর্বপুরুষ জাঙ্গিলদের একজনেরও অস্তিত্ব নেই। বিলোপ ঘটেছে তাদের। পোর্টব্লেয়ারে নির্মিত উপজাতি-মিউজিয়ামে এদের কোনো অস্তিত্বই নেই।

কেন না, এদের সম্পর্কে কোনো তথ্য এখন উপলব্ধি নয়। পোর্টব্লেয়ার থেকে সমুদ্রপথে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হ্যাভলক সৈকতে বসে সেই কথাই বলছিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। উন্নয়ন কাদের জন্য? যারা এখানকার প্রকৃত অধিবাসী, তাদের চাহিদা-প্রয়োজন সম্পর্কে যদি কোনও ধারণা না থাকে, তা হলে তথাকথিত উন্নয়ন-বিকাশ এদের কাছে অভিশাপ হয়ে ওঠে। জোর করে উন্নয়নের শরিক করার তাগিদে এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে। জারোয়া শব্দের অর্থই ভূমিপুত্র। অথচ ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা এখন ঋত্বিক ঘটকের চিত্রনাট্যের সংলাপের মতোই- ‘বায়ুভুক নিরলঘু’ জীব। বিচ্ছিন্নতা জীবিকা থেকে, সংস্কৃতি থেকে- এক কথায় স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে। অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছের জীবন যতক্ষণের ততক্ষণেরই এদের আয়ু। তাই তো বিলুপ্তির পথে এরা।

সমস্যাটা কেবলমাত্র এ অঞ্চলে নয়, পৃথিবীর যেখানেই এই ধরনের আদিম মানুষের বাস, সেখানেই সভ্য মানুষের আক্রমণে বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের পূর্বজরা। ব্রাজিলে আদিম আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির নামে পশুখামারের বণিকরা দখল করে নিয়েছে ইন্ডিয়ানদের জমিজোত-বসতবাটি। আকুনৎসু উপজাতিদের মধ্যে এখন মাত্র পাঁচজন বেঁচে রয়েছে। একইভাবে পেরুতে তেল নিষ্কাশনের সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চাশ শতাংশ নাহুয়া উপজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। জল-জঙ্গলের স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর কাছে বিষময় হয়ে গিয়েছে দূষণ। প্রতিরোধ ক্ষমতার স্বল্পতা তাদের সহজেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

পূর্ব আমাজনের জঙ্গল ক্ষয়ের সঙ্গে বিপন্ন হয়েছে আদিম শিকারি উপজাতি আওয়া সম্প্রদায়। গুটিকয়েক উপজাতি বেঁচে রয়েছে। তাই প্রয়োজন হয়ে উঠেছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো আদিম মানব সংরক্ষিত অঞ্চলের। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, আন্দামানের কৃষ্ণকায় অবয়ব, কুঁচকানো কেশ, পরনে নারকেল গাছের পাতা সরু করে কাটা মালা দিয়ে তৈরি স্কার্ট পরিহিতা প্রায় নগ্ন জারোয়া রমণীদের উদ্দাম নৃত্যের কাহিনি।

ট্যুরিস্ট আকর্ষণের জন্য এদের খেলনার মতো ব্যবহার করার কাহিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শোরগোল ফেলে দেয়। সচেতন হয় ভারত সরকার।

বঙ্গোপসাগরের ওপর ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে আন্দামান-নিকোবর। তার মধ্যে ৩৭টিতে মানুষের বসবাস। আদিম উপজাতিরা ছাড়াও এখন মূল ভূখণ্ডে বাঙালি-তামিল-মালয়ালি-পাঞ্জাবিদের বাস। এই সভ্য ভূখণ্ডের অধিবাসীরা এখন তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া। আজ আন্দামান আর কালাপানির দেশ নয়। এখানেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সঙ্গে ভূমিপুত্রদের অধিকারের মধ্যে বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। প্রাধান্যে রয়েছে এইসব মূল ভূখণ্ডে ত্যাগীদের চাহিদার যোজনা। তার সাফল্য-অসাফল্য এখন ভোটযুদ্ধের প্রধান বিষয়।

ভোটের কারণে প্রায় তিন লক্ষ অধিবাসীদের জমি-জীবিকার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দেয়ার প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি পেছনে ফেলে দিয়েছে আদিম মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা।

আধুনিক জীবনের প্রভাব বলতে এইসব নিরীহ আদিবাসীরা এখন অধিকাংশই অন্যান্য রোগ ব্যতীত যৌনরোগের শিকার। সভ্য মানুষের এই বিকৃত চরিত্রের বিষয়ে এসব আদিম মানুষ অজ্ঞ।

এই রোগ প্রতিরোধ করার মতো শারীরিক প্রতিষেধক ক্ষমতা নেই ফলে শরীরে বিষাক্ত লোহিত কণিকা ক্রমেই নির্জীব করে তুলছে এদের। একসময় এদের সংখ্যা ছিল প্রায় আট হাজারেরও বেশি। বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের আগমনে এদের সংখ্যা তিন-চতুর্থাংশ কমে যায়। এখন সংখ্যাটা প্রায় ৪০০। তাও প্রতিদিনই কমছে। আরেক উপজাতি ওঙ্গেদের সংখ্যা এখন ১০০-তে নেমে এসেছে।

প্রকৃতিসৃষ্ট এই স্বাভাবিক অরণ্য এখন বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠছে এমনকী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এইসব আদিম উপজাতিদের সভ্যতার সংস্পর্শে নিয়ে আসার উদ্যোগের আড়ালে ভূমিপুত্রদেরই গৃহহীন করে তুলছে। বিপদের মূল উৎস এটাই। এইসব আদিম মানুষের সভ্যতার সংস্পর্শে নিয়ে এসে তাদের যাযাবর জঙ্গলভিত্তিক জীবন ত্যাগ করানোর মধ্যে কোনও সাধু উদ্দেশ্য আছে কিনা- এটাই বিচার করার সময় এসেছে। পূর্বভুদের বাঁচিয়ে রাখাই হবে মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য।

সাংবাদিক-কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত