ঋণ একটি অভিশাপ। আজকের বাংলাদেশে হাজারো পরিবার ঋণের বোঝায় জর্জরিত। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে পরিবার প্রতি গড় ঋণের পরিমাণ ছিল- ৩৭ হাজার ৪৪৩ টাকা। সেটি ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা। অর্থাৎ দিন দিন ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋণগ্রস্ত পরিবারের সন্তানদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। মানুষ বিভিন্ন কারণে ঋণ করে থাকে এবং ঋণের ধরন ও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কেউ কেউ বন্ধক সিস্টেমে ঋণ করে, কেউ সাধারণ ঋণ করে এবং কেউ আবার সুদের বিনিময়ে ঋণ করে থাকে। সুদের বিনিময়ে ঋণ খুব ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। সুদ দেয়া ও নেয়া উভয়ই সমান অপরাধী। কিন্তু সমাজের কিছু লোক আছে যারা গরিব অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে সুদের ব্যবসা করে থাকে।
ঋণগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান কমে যায় এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবসময় কলহ লেগেই থাকে। শিশুরাদের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব পড়ে। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। একটি শিশু ঋণগ্রস্ত পরিবারে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। যার ফলে শিশুদের কোমল হৃদয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া একজন শিশু আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে না। ঋণগ্রস্ত পরিবারে শুধু শিশুরাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে না, এর প্রভাব পরে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ওপর। ঋণ পরিশোধের চাপে অভিভাবকদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সংকট দেখা দেয়। বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ঋণের চাপে ধর্মীয় অনুভূতি থেকেও বেরিয়ে আসে। তাছাড়া ঋণগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো শরীরের যত্ন নিতে পারে না। ফলে খুব সহজেই অসুস্থ হয়ে যায়। অসুস্থ সদস্যদের চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাই।
আমরা রাস্তায় অসহায় গরিবদের সংগ্রাম সংগ্রাম করতে দেখেছি। মানবতার খাতিরে আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা অরি অথবা তাদের সংগ্রাম সরাসরি দেখতে পাই। কিন্তু ঋণগ্রস্ত পরিবার তাদের থেকেও বেশি সংগ্রাম করে তা কি আমরা ভাবি? ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে একজন বাবা দিনরাত পরিশ্রম করে যখন বাসায় ফিরে তখন আবার ঋণদাতা এসে হাজির। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সারাদিন কাজ করে একজন বাবা যখন রাতে মুখে ভাত নিতে গিয়ে শুনে ঋণদাতা বলছে টাকা পরিশোধ না করে তোমরা তো সুখেই আছো। তখন আর ভাত মুখে ওঠে না। বাবাদের চোখ থেকে খসে পড়ে জল। অনেক পরিবার আছে বাবা নেই। ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ ও পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে একজন মা ঋণ গ্রহণ করে। একজনের ঋণ পরিশোধ করতে আরেকজনের থেকে ঝণ নেয়। এভাবেই ঋণের বোঝা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ঋণের চাপে অনেকে আত্মহত্যার পথ ও বেছে নেয়।
বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিবার ঋণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আমার দেখা বেশ কয়েকটি পরিবার ঋণের কারণে প্রায় ধ্বংসের পথে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য দুটি পরিবার রয়েছে যার পরিণতি দেখে আমি খুবই মর্মাহত। ঋণের বোঝা মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে! ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে রাতের আঁধারে পাড়ি জমান শহরে। ঋণদাতা বাড়িতে এসে গালাগালি করে। এমনকি শহরে যেখানে চলে গেছেন চাকরির খোঁজে সেখানেও ঋণদাতা এসে হাজির হয়ে যান?। এজন্য আবার জায়গা পরিবর্তন করেছে। একমাত্র ঋণের বোঝা বইতে না পেরে তারা প্রতারণার পথ বেছে নিয়েছে। সেই সাথে তাদের পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে। এমনই ঋণগ্রস্ত আরেকটি পরিবার যেখানে ঋণের চাপে পরিবারের বিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়ে গেছে। একজন আরেকজনের উপর দোষ চাপিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।
ৎঋণের বোঝা কতটা ভারী হলে পারিবারিক বিচ্ছেদ ঘটে? এমন আরো অনেক পরিবার রয়েছে ঋণের বোঝা কমাতে গিয়ে দিন দিন আরো ঋণ করছে। একটু সুখের আশায় পরিবারের সদস্যদের বিদেশে কাজ করতে পাঠায় ঋণ করে। প্রবাস জীবন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ভালো সুবিধা হলে তো ভালো। কিন্তু বেশিরভাগই সুবিধাচ্যুত হয়ে থাকে। ফলে পারিবারিক ঋণের পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। আমার মনে হয় ঋণ করে বিদেশে না পাঠানোই ভালো। একজন যুবককে নিজ দেশেই কাজের ব্যবস্থা করে নেয়া উচিত। এতে দেশের সম্পদ দেশেই ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? বর্তমানে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া ও মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে একজন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। একজন দিনমজুর প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা আয় করে একটি পরিবার কীভাবে চালাতে পারে? যেখানে এক কেজি মাছের দাম ৩০০ টাকা। আর সবজি মশলার দাম তো আকাশ ছোঁয়া। চালের দাম ৭০-৮০ টাকা কেজি হলে একজন রিকশাওয়ালার পরিবারের অবস্থা কোথায় দাঁড়ায়? যারা সরকারি চাকরি করে তারা সামান্য বেতনে তার পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মেটাতে না পেরে অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়ে, ঘুষ নেয় অথবা ঋণ করে। একজন শিক্ষক সেরা সম্মানের পেশায় চাকরি করেও সামান্য বেতনে পরিবারের সম্মান বজায় রাখতে অক্ষম।
একজন সুইপার আমাদের পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সামান্য টাকা নিয়ে পারিবারিক সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে পারে না। একজন নিরাপত্তা কর্মী অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সামান্য অর্থ নিয়ে নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। ফলে তারা ঋণ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। একজন কৃষক একবার ফসলের এদিক সেদিক হলেই ঋণ করে থাকে। ফলে এই ঋণের বোঝা সারাবছর ধরে মাথায় নিয়ে বেড়ায়। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আয় ব্যয়ের বৈষম্য। পরিবারের আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি হলে ঋণের প্রয়োজন হয়। নিম্ন আয়ের মানুষদের ঋণ নেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়াও আমাদের দেশে বেকারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণ ছাড়া অচল হয়ে পড়ে কিছু কিছু পরিবার। আয়ের কোনো স্থায়ী উৎস না থাকলে পরিবার চালানোর জন্য ধারদেনা করতে হয়। শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে খরচ বৃদ্ধি পাওয়া ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে। কৃষি খাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি বা বাজার মূল্য পতনের কারণে কৃষকরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখতে বা আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্যও অনেকে ঋণ করে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে বা নতুন উদ্যোক্তারা ঋণ গ্রহণ করে থাকে। কর্মসংস্থান সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দা ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ। জীবন যাপনের তাগিদে অনেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে থাকে। ফলে ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপের কারণেও ঋণ হয়ে থাকে। বিয়ের অনুষ্ঠান, উৎসব বা ?সামাজিক অনুষ্ঠানের খরচ মেটাতে ঋণ করে থাকে। এসবের জন্য একবার ঋণ নিলে তা শোধ করতে আবার ঋণ নিতে হয়। ঋণের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আরো বেশি ঋণ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ঋণগ্রস্ত পরিবারের মুক্তি ও স্বস্তির প্রয়োজন। শারীরিকভাবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও মানসিক চাপ নিয়ে বেঁচে থাকা সত্যিই পৃথিবীর সেরা সংগ্রাম। ২০২৪ এর গণ অভ্যুত্থানের পরে সবকিছুর সংস্কারের কথা আসলেও আসেনি ঋণগ্রস্ত পরিবারের মুক্তির পথের দাবি। অধিকাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কি নিয়ে? দেশের জনগণই একটি দেশের সম্পদ। জনগণকে মানসিক চাপে রেখে বাংলাদেশ কখনোই এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই সবার আগে ঋণগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত। ঋণ সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজে বের করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা হতে পারে একটি বিরাট সমাধান। অধিকাংশ পরিবার স্বল্প আয়ে অধিক দামে দ্রব্য কিনতে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণ করে থাকে। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সেরা উপহার।
তাছাড়াও বেকারত্বের হার কমানো হবে আরো একটি উল্লেখযোগ্য সমাধান। একটি পরিবার সঠিকভাবে চালানোর জন্য নির্দিষ্ট আয়ের উৎস থাকা বাধ্যতামূলক। তাই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি হতে পারে আরেকটি সেরা উপহার। ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে হবে। কর সংগ্রহ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে এবং করনীতিতে সংস্কার এনে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। এতে চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে না এবং সহজেই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। এছাড়াও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হবে। রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করতে হবে এবং আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রবাসী রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। তবে প্রবাসি গণহারে প্রবাসে না গিয়ে দেশেই আয়ের উৎস খুঁজে নিতে হবে। এজন্য দেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্য সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। কৃষিশিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঋণের বোঝা কমাতে পরিকল্পিত ও দক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কেননা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে একটি দেশ এগিয়ে যাওয়া তো দূরে,কখনো সঠিকভাবে দাঁড়াতে পারবে না। তাই বাংলাদেশ সংস্কারের আগে ঋণের বোঝা কমাতে এগিয়ে আসুন। ঋণগ্রস্ত পরিবার ঋণের বোঝা কমাতে পারলে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পাবে। সেই সাথে পাবে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা। ঋণের চাপ কমে ভালো থাকুক সবাই, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া