ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লিঙ্গগত স্টেরিওটাইপ ভাঙার পথে পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের নতুন মাত্রা

ইঞ্জিনিয়ার একেএম রেজাউল করিম
লিঙ্গগত স্টেরিওটাইপ ভাঙার পথে পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের নতুন মাত্রা

সমাজে লিঙ্গগত সম্পর্কের যে চিত্র বহু যুগ ধরে আঁকা হয়েছে, তা শুধু পুরুষ ও নারীর মধ্যকার বৈষম্য নয়, বরং তাদের পারস্পরিক উপলব্ধি ও সম্পর্কের ধরনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে, নারীকে রহস্যময় এবং পুরুষকে শক্তি ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার প্রবণতা সমাজে এতটাই শিকড় গেড়েছে যে, আমরা প্রায়ই এই ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবিই না। নারীকে ‘রহস্যময়’ হিসেবে দেখা এবং পুরুষকে ‘সরল’ বা ‘দৃঢ়’ হিসেবে উপস্থাপন করার সংস্কৃতি মূলত সাহিত্য, শিল্পকলা এবং জনপ্রিয় মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচলিত হয়েছে। সিনেমায় নায়িকা কখনো ধোঁয়াটে চেহারার রহস্যময়ী, আবার কখনো প্রেমে পড়া এক নিরীহ তরুণী। অপরদিকে, নায়ক প্রায়ই সাহসী, দুঃসাহসী এবং আবেগ লুকিয়ে রাখা চরিত্রে উপস্থাপিত হয়।

এই চিত্রকল্পের প্রভাব কী? : এ ধরনের সামাজিকীকরণ পুরুষ ও নারী উভয়েরই ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নারীরা প্রায়ই আবেগপ্রবণ ও কোমল হিসেবে সামাজিকীকরণ হয়, যা তাদের ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাসকে সীমিত করে। অপরদিকে, পুরুষদের শেখানো হয় যে শক্তি এবং কর্তৃত্বই তাদের মূল গুণ, ফলে আবেগ প্রকাশ বা দুর্বলতা দেখানোকে দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পরিবর্তনের প্রয়োজন কেন? : একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে পুরুষ ও নারী উভয়কে সমানভাবে আবেগপ্রকাশ এবং সৃজনশীলতার সুযোগ দিতে হবে। পুরুষের অনুভূতি এবং নারীর নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা- দুটোই সমানভাবে মূল্যায়ন করা দরকার।

কীভাবে স্টেরিওটাইপ ভাঙা সম্ভব?

সচেতনতা বৃদ্ধি : আমাদের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা কীভাবে লিঙ্গ পরিচয়কে দেখি এবং তা কীভাবে আমাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

শিক্ষার মাধ্যমে পরিবর্তন : শিক্ষাব্যবস্থায় এমন এক পাঠ্যক্রম প্রয়োজন, যা লিঙ্গ সমতার উপর গুরুত্ব দেয়। ছেলে-মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে যে, শক্তি ও অনুভূতি উভয়ই তাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।

মিডিয়া ও সংস্কৃতির ভূমিকা : সাহিত্য, সিনেমা এবং নাটকে এমন চরিত্র নির্মাণ করতে হবে, যেখানে নারী এবং পুরুষ উভয়ের মধ্যে সমতার প্রতিফলন ঘটবে। পুরুষকে কেবল বীরত্বের প্রতীক নয়, একজন স্নেহশীল পিতা বা আবেগপ্রবণ বন্ধুর ভূমিকায়ও তুলে ধরতে হবে। একইভাবে, নারীকে শুধুমাত্র সৌন্দর্যের প্রতীক না করে নেতৃত্বের ভূমিকায় উপস্থাপন করতে হবে।

সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ : কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং পুরুষের পরিবারিক দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষ যদি পরিবারের দেখভাল করে, তবে তাকে সামাজিকভাবে প্রশংসা করতে হবে, ঠিক যেমন কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নারীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

সম্পর্কের নতুন মাত্রা : যখন লিঙ্গভিত্তিক স্টেরিওটাইপ ভেঙে যাবে, তখন সম্পর্কের নতুন মাত্রা উন্মোচিত হবে। একজন পুরুষ এবং একজন নারী তখন কেবল লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়, বরং ব্যক্তি হিসেবে একে অপরকে গ্রহণ করতে শিখবে। এতে করে সম্পর্কগুলো আরো গভীর, পরিপূর্ণ এবং মানবিক হবে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই, যেখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে। লিঙ্গের পরিচয় পেরিয়ে মানুষ হিসেবে একে অপরকে দেখার সময় এসেছে। একমাত্র তখনই আমরা সত্যিকারের মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। লিঙ্গের বাইরে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখাই পারে আমাদের সম্পর্ককে আরো সমৃদ্ধ ও অর্থবহ করতে।

কলামিস্ট, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত