ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বার বার হোঁচট খাচ্ছে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা

অলোক আচার্য
বার বার হোঁচট খাচ্ছে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনার কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি হলো সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি।

তাই বর্তমানে ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ক্রমেই স্থলভাগের সম্পদের থেকে সমুদ্রের জলরাশির নিচে ডুবে থাকা সম্পদের দিকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর চোখ পড়ছে।

সত্যিকার অর্থেই সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের প্রাপ্যতা ও তার সঠিক ব্যবহারের ওপরেই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতি প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ভর করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করা পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ এসব ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হচ্ছে। ভূখণ্ডের কৃষিজমি দখল করে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিচ্ছে মানুষ। বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে প্রতি বছর। ফলে কৃষি জমির বাইরে খাদ্যের জন্য মানুষ অনেক আগে থেকেই সমুদ্রনির্ভর হয়েছে। সামুদ্রিক মাছ দেশের বাইরে রপ্তানি করে ও সামুদ্রিকা প্রাণী শিকার করে তা দেশের বাজারে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করে বিক্রি করে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা হচ্ছে। এখানেই ব্লু ইকোনোমির ধারণা আরো জোরদার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদ। ৩০ ভাগ জ্বালানি তেল ও গ্যাস আসছে সাগর থেকেই। এই বিশাল সমুদ্রে বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক শালিসি আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ যা আরেকটি বাংলাদেশের সমান। এরপর মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪১৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর থেকেই সমুদ্র ঘিরে স্বপ্ন গড়ে ওঠে।

দেশের সমুদ্র অর্থনীতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হলে আগামী ৫ বছর পর সি-ফুড রপ্তানি করে প্রতি অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদ আহরণ করতে এবং কি পরিমাণ সম্পদ এবং কোন কোন সম্পদ কত পরিমাণে রয়েছে তা অনুসন্ধান করতে যে প্রযুক্তির প্রয়োজন তা আমাদের নেই। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সাতটি কোম্পানি দরপত্র সংগ্রহ করে। চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল। নির্ধারিত সময় একটিও প্রস্তাব জমা হয়নি।

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দু’টি ব্লককে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি। বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ২৪টি ব্লককে (গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয় চলতি বছরের ১১ মার্চ। দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর‌্যন্ত) সময় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরো তিন মাস সময় বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে দরপত্রে নয় মাস (৯ ডিসেম্বর-২০২৪ পর্যন্ত) সময় বাড়িয়েও লাভ হয়নি। সেক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হলো না এবারও। ঠিক একই সময়ে বসে নেই প্রতিবেশী দেশগুলো।

পৃথিবীর অধিকাংশ অংশই এই সুবিশাল সমুদ্র। আমাদের দেশের দক্ষিণে বিশাল সমুদ্র এলাকা ঘিরে এখন নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এই জলরাশির রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

যাতে করে আমাদের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। পাল্টে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র। কিন্তু এই নীল জলরাশির যে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে তা অনেকের কাছেই বহুবছর অজানা ছিল। এই সমুদ্র ঘিরে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কলম্বাস থেকে শুরু করে সুম্রদের বুকে নিশানা টানিয়ে আবিষ্কারের নেশায় ছুটে বেড়িয়েছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের চিন্তা ধারায় পরিবর্তন ঘটতে লাগলো। সমুদ্র যে সম্পদে পরিপূর্ণ তা বুঝতে শিখল।

অর্থনীতির উন্নয়নে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির যে ভূমিকা আছে মানুষ তা জানে। আর জানে বলেই এক দেশ অন্য দেশের সাথে সমুদ্রে আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ বা যুদ্ধ হুমকীতে জড়াচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। চীন বা জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো আরো দুই তিনশ’ বছর আগে থেকেই সমুদ্রনির্ভর কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক দেশের সিংহভাগ জাতীয় আয়ই আসে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি থেকে। বাংলাদেশের মৎস সম্পদের একটি বড় অংশই সমুদ্র থেকে আসে। যদিও উপকূল থেকে মাত্র ৬০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাছ ধরার সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের।

সেই সাথে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাও সমুদ্রের উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। বহু বছর ধরেই এসব জনগোষ্ঠী নৌকায়, ট্রলারে মাছ ধরে, জাল বুনে, মুক্তা ও চিংড়ি চাষ করে, লবণ শিল্প গড়ে তুলে আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা যদি আমাদের সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে দেশের টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা এবং জাতীয় আয়কে আরও সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। সেভ আওয়ার সি এর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পরে।

এর মধ্যে ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। পেট্রোবাংলার গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড বা শ্যাওলা, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস রয়েছে। সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত হতে পারে ব্লু-ইকোনমি। ব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণা দেন। বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু।

পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তৈল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে।

২০২৫ সালে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে দেশের সরকার। লোনা পানির বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ আহরণ অনেক আগে থেকেই করে আসছে। তবে এ পরিমাণ অনেক অনেক কম। উন্নত প্রযুক্তি ও জাহাজের অভাবে অনেক সামুদ্রিক অনেক গভীর এলাকা থেকে মৎস আহরোণের পরিমাণ অনেক কম। এখন মানুষ জানতে পেরেছে রহস্যময় এ বিশাল জলরাশির ভেতর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর শক্তির অফুরন্ত উৎস। জ্বালানি তেল, গ্যাস এসব প্রাকৃতিক সম্পদ পৃথিবীর ভূখণ্ডের থেকেও বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত রয়েছে সমুদ্র বক্ষের নিচে। রয়েছে বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্য, আগ্নেয়গিরি, পাহাড়-পর্বত। মানুষের চাহিদা মেটানোর সব উপকরণ সেখানে আছে। কিন্তু নিজেদের সামর্থ্য এবং পরিকল্পনার দুর্বলতায় সমুদ্রকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি আমরা। নিজেদের অর্থনীতি, জীবন ও জীবিকার স্বার্থেই সমুদ্র অর্থনীতি চাঙ্গা করা দরকার।

প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত