ঢাকা ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সিরিয়ার আকাশে শকুনের ভীড়

আফতাব চৌধুরী
সিরিয়ার আকাশে শকুনের ভীড়

আজ যখন বিংশ শতকের শেষ দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতিকে ফের উসকে দিয়ে বিশ্ব টেলিভিশনের পর্দায় রাতের দামাস্কাসের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধের ‘লাইভ’ ছবি ভেসে উঠছে, আজ যখন ফের রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের দোষ পশ্চিমের দাদারা নিজেরাই তদন্ত করে, বিচার করে সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ প্রশাসনের শাস্তির বিধান নিজেরাই ঠিক করে ফেলছে, আজ যখন ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির উপর এসে পড়ছে, তখন কয়েকটি প্রশ্ন ক্রমশ বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।

প্রথমত, সব ধরনের কুটনৈতিক শিষ্টাচার, আন্তর্জাতিক আইনকে জলাঞ্জলি দিয়ে ওয়াশিংটন আর দুই দোসর লন্ডন এবং প্যারিস কীভাবে একটা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র সিরিয়ার উপর এ ধরনের হামলা করতে পারে? কে তাদের একবিংশ শতকে এই অধিকার দিয়েছে? দ্বিতীয়ত, ক্ষেপণাস্ত্র হানার সময়ই বা হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো করে নির্ধারণ কেন হলো? ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক কর্তার কথায় এটা স্পষ্ট যে, হামলার ব্যাপারে যে যথাযথ আলোচনা হয়নি তা-ই নয়, অনেকের আপত্তি উড়িয়ে ওভাল অফিস এই হামলার সবুজ সংকেত দিয়েছে।

কিন্তু কেন এই হঠাৎ উড়েপড়ে পিছনে লাগা? এ প্রশ্ন ওঠার সঙ্গত কারণও রয়েছে। গেল এপ্রিল মাসের গোড়ায় বাল্টিক সাগর তীরবর্তী তিন দেশ লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া আর এস্তোনিয়ার, রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমি সিরিয়া থেকে বেরোতে চাই, সেনাবাহিনীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই’। তার এই বাসনার কারণ ব্যাখ্যা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছিলেন, আইএস জঙ্গিদের নিকেশ করতেই মার্কিন সেনারা সেখানে গিয়েছিল। সেই কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। পশ্চিম ইরাক আর পূর্ব সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে আবু বকর আল- বাগদাদির নেতৃত্বে আইএস জঙ্গিরা এক সুন্নি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছিল। মার্কিন সেনাবাহিনীকেও বেশ কালঘাম ছুটিয়েই কাজটা করতে হয়। এখন সেই ট্রাম্পই যখন ৩৬০ ডিগ্রি ডিগবাজি খেয়ে আসাদকে ‘জন্তু’ বলে সিরিয়ায় ফের ক্ষেপণাস্ত্র হানা চালালেন, তখন তো প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

ওয়াশিংটনের অবশ্য চটজলদি একটা উত্তর রয়েছে। দামাস্কাসের শহরতলির দৌমায় শিশুদের বীভৎস পুড়ে যাওয়া দেহগুলো দেখে ওভাল অফিস বিচলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, আর দেরি নয়। আসাদের রাসায়নিক অস্ত্রাগার অবিলম্বে ধ্বংস করতে হবে। এমনকি ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরে ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট বেশ জাঁকজমক করেই ট্যুইট করেছেন, ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ বলে। কিন্তু তাতেও গোল দেখা দিয়েছে। শ’খানেক ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরও যে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রাগার পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি, তা পেন্টাগনও স্বীকার করে নিয়েছে। বাধ্য হয়ে ওয়াশিংটন আবার হামলার রাস্তায় হাঁটার হুমকি দিচ্ছে। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? বুশের মতো ইরাক ছাড়ার শূন্যগর্ভে আস্ফালন হবে না তো ট্রাম্পের? ছাড়া তো দূরে থাক, বরং সিরিয়ার রাজনীতির চোরাবালিতে মার্কিন সেনাবাহিনী আরো বেশি দিন সিরিয়ায় থাকার অজুহাত খুঁজে পাবেনা তো? একটা কথা কিন্তু মাথায় রাখা প্রয়োজন। ভিয়েতনাম থেকে আফগানিস্তান, ইরাক যে দেশেই ওয়াশিংটন দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ে জড়িয়েছে, সেখানেই পেন্টাগনের কোনো সুখস্মৃতি হয়নি।

ট্রাম্পের এই চটজলদি ডিগবাজির মধ্যে অবশ্য অন্যরা ভিন্ন কারণ দেখেছেন। যখন থেকে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর নির্বাচনি ‘আপসেট’ করে হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টনকে হারিয়ে ওভাল অফিসের মেহগনি কাঠের টেবিল-চেয়ারে আসীন হয়েছেন ট্রাম্প, তখন থেকেই ঘরে বাইরে বিতর্ক তার পিছু ছাড়ছে না। তা সে রুশ সাহায্য নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার করার অভিযোগই হোক, যৌন হেনস্তার অভিযোগই হোক বা পুরোনো সহকর্মীদের সমালোচনায় বিদ্ধ হওয়াই হোক। এমনকি ট্রাম্পকে ইমপিচ করার কথাও মাঝেমধ্যেই ভেসে বেড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের খ্যাতি মোটেও মধ্য গগনে নেই। দীর্ঘদিনের এমন সব চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসন সরে আসছে, যাতে একদিকে মার্কিন বন্ধ দেশরা শুধু যে চটছে তা-ই নয়, ক্রমশ বিশ্বের বাজারে ওয়াশিংটনের চোখে চোখ রেখে কথা বলা বেজিংয়েরই আদতে সুবিধা হয়ে যাচ্ছে।

বিস্তর ঢাকঢোল পিটিয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে যে বাণিজ্যযুদ্ধে নেমেছেন ট্রাম্প, তাতে ক্রমশ মার্কিন শিল্পমহল শঙ্কায় প্রমাদ গুনছেন যে, এই লড়াইর নিটফলে গুগলের মতো দেড়শ’ কোটি লোকের বিশাল চিনা বাজারের দরজা অচিরেই না তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখন ভারত ও ইউরোপের বাজারে বাধ্য হয়ে দাম কমাতে হবে। অর্থাৎ, চীনকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে মার্কিন শিল্পই মার খেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা পুরোমাত্রায় রয়েছে। আর তা যদি হয়, ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী হয়ে ভালো জানেন, তার থেকে মার্কিন শিল্পমহলের মুখ ফিরিয়ে নিতে এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। সেটা হলে ২০২০ সালে তার দ্বিতীয়বারে জেতার আশা যে বুদবুদের মতো মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না, তা-ও অজানা নয়, ট্রাম্পের। তাই অসুস্থ সিরীয় শিশুদের ওপর অন্যায়ের শোধ নিয়ে মার্কিন জনমানসে এমন ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভাবমূর্তি আনার সোনার সুযোগ কেউ কি ছাড়ে?

আর যে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের দোষের কারণে ওয়াশিংটনের এত গোসসা, তার দোসর আতলান্তিকের অপর পারের লন্ডন কি বুকে হাত রেখে বলতে পারে এই কালনাগিনী তাদেরই হাত দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর মেসোপটেমিয়ায় ঢোকেনি? প্রসেনজিৎ বসু তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘এশিয়া রিবর্ণ-এ বলেছেন, অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে ১৯২০ সালে তৎকালীন ইংরেজ উপনিবেশ সচিব উইনস্টন চার্চিল বসরা, বাগদাদ মসুলের রাজা করে ফয়ছলকে বসালেন। কিন্তু জনগণ এ রকম তাঁবেদার রাজাকে মানতে চাইল না। ফলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। তখন বিমান বাহিনীকে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিলেন চার্চিল। হাজার বিশেক মানুষকে হত্যা করে বিদ্রোহ থামাল ব্রিটেন। ১৯২০ সালেই পশ্চিম এশিয়ায় পা রাখল রাসায়নিক অস্ত্র। এমনকী ১৯১৯ সালে চার্চিল বেশ গর্ব করে বলেন ‘আমি অসভ্য উপজাতিদের ওপর বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগের পক্ষে। এতে মরবে কম কিন্তু সমুচিত শিক্ষা হবে।’

আদতে সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়ায় রাসায়নিক পানিগোলা শুরু হয়েছে। আসাদ প্রশাসন বিদ্রোহী বাহিনীকে শায়েস্তা করতে বারবার দেশের নিরীহ জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ করছেন- এ অভিযোগ ওয়াশিংটন আর তার দোসররা বারবার করে আসছে। প্রতিবারই আসাদ প্রশাসন আর তার মূল মদতদাতা মস্কো তা ‘পশ্চিমের অপপ্রচার’ বলে অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতার দৌমায় হামলা হঠাৎ এই চাপানউতোরকে এক লহমায় সংঘর্ষের স্তরে নিয়ে এসেছে। বিশ্ব শিউরে উঠেছে একের পর এক নিথর হয়ে যাওয়া শিশুর শরীর দেখে। ওয়াশিংটন সরাসরি আঙুল তুলেছে দামাস্কাসের বাসার আল-আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, বিদ্রোহী বাহিনীদের ঘাঁটিতে হানা দেয়ার অজুহাত দিয়ে কয়েকশ’ শিশুর ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুদের ওপর কেøারিন বা সারিনের মতো বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে বলে সিরিয়ায় কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-র রিপোর্টেও একই কথা বলছে যদিও সিরিয়া বা মস্কো এ অভিযোগ মানতে চায়নি।

পশ্চিমের সঙ্গে এই সংঘাতের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে বিংশ শতকের প্রথম ভাগের পশ্চিম এশিয়ার এক অস্থির সময়ের মধ্যে যখন যুদ্ধ, গণহত্যা, বিদ্রোহ, গুপ্তহত্যা রক্তস্রোতের মধ্যে ধীরে ধীরে চারশ’ বছরের এক সাম্রাজ্যের ধ্বংস স্তূপের মধ্য থেকে জন্ম হচ্ছে আধুনিক তুরস্কের। একই সঙ্গে তৎকালীন বিশ্বের দুই অধীশ্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে পশ্চিম এশিয়ার আরবভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাগ-বাটোয়ারায় ব্যস্ত। এই কাজটা আদতে শুরুই হলো যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাভূত অটোমান সাম্রাজ্যকে নিজেদের কব্জায় পেয়ে গেল ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স।

১২৯৯ সালে তুর্কি ওঘুস উপজাতির নেতা ওসমানের হাত ধরে আনাতোলিয়ার (তুরস্কের প্রাচীন নাম) সোগুট শহরে যে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল, যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ আর পশ্চিম মধ্য এশিয়ার বিশাল অংশে বিস্তার করেছিল, বিংশ শতকের গোড়া থেকেই তার পতন শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় এই সা¤্রাজ্যের কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দেয় আর তার ফলে খণ্ডবিখণ্ড সাম্রাজ্য থেকে পৃথক পরিচিতি পায় সিরিয়া, ফরাসি উপনিবেশ হয়ে।

পড়শী দেশ ইরাক যায় ইংরেজদের দখলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর এশিয়ায়, যখন লড়াই করে ইঙ্গ-ফরাসি দুটো ঔপনিবেশিক শক্তির সামরিক ক্ষমতা তলানিতে ঠেকেছে, তখনই পশ্চিম এশিয়ার এই দুই দেশ স্বাধীনতার স্বাদ পায়। অবশ্য ততদিনে রাজদন্ড ফের বণিকের মানদ-ে রূপান্তরিত হয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার তেল ভাণ্ডার ইঙ্গ-ফরাসি শুধু নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে তা-ই নয়, নতুন পরাশক্তি ওয়াশিংটনকেও ডেকে এনেছে লুটের ভাগ দিতে। তাই যেনতেন প্রকারে পশ্চিম এশিয়াকে হাতে রাখতেই হবে ওয়াশিংটন-লন্ডন-প্যারিসকে।

অতঃপর আর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণের অজুহাতের অভাব হবে না। অজুহাত আসাদ জমানার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার এবং সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ। এই অঞ্চলকে তাদের হাতে রাখতেই হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত