ঢাকা ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

পতিত ও বিতাড়িত স্বৈরাচারের আমলে সিন্ডিকেটবাজরা সক্রিয় ছিল। বাজার থেকে শুরু করে পরিবহন, টেন্ডার, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রফতানিসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে সিন্ডিকেটবাজি ছিল না। সিন্ডিকেটবাজ কারা ছিল, তা বিশদভাবে বলার অবকাশ নেই। সবাই জানে, তারা ছিল সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সরকারের কাছের মানুষ ও অনুগত ব্যবসায়ী। সে সময় সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা সিন্ডিকেট নির্মূল করার তাকিদ উচ্চারিত হয়েছে। সরকার কারো কথাই শোনেনি। ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেয়নি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। তখন নিত্যপণ্যের দাম কখনো স্থিতিশীল হয়নি। সব সময় ওঠানামা করেছে। ১০ টাকা বেড়েছে তো পরে ৫ টাকা কমেছে। আবার সেই পণ্যের দামই আরো পরে ১৫ টাকা বেড়েছে। অকারণ, অহেতুক দাম বাড়ার খেসারত দিতে হয়েছে ক্রেতা-ভোক্তাদের। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, পেঁয়াজ-রসুন মশলাপাতি, তরিতরকারি ইত্যাদি সকল নিত্যপণ্যের দামই যথেচ্ছ বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ব্যাপারে তার অক্ষমতার কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট কতটা শক্তিশালী, তার একথা থেকেই সম্যক উপলব্ধি করা যায়। স্বৈরাচারের বিদায়ের সময় মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি এতটাই বেড়েছিল যে, অতীতের সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করেছিল। ১০/১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ঘটলে সাধারণ ও দরিদ্র-অতিদরিদ্র মানুষের অবস্থা কতটা নাজুক হয়ে পড়ে, তা বলে বুঝানো যাবে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে অগনন নির্দিষ্ট ও অল্প আয়ের মানুষ তাদের পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছিল। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনও তারা পূরণ করতে পারেনি অর্থাভাবে। পূর্বাপর অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝেছিল, ওই সরকার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই স্বৈরসরকার বিদায় নিয়েছে পাঁচ মাস হলো। ছাত্র-জনতার অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায়। কিন্তু এখনো বাজার পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। বাজার সিন্ডিকেট এখনো দোর্দণ্ড- প্রতাপে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা বাজার সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেছেন, বাজার সিন্ডিকেট এখনো আছে। হাত বদলের মাধ্যমে দাম বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি তা নিয়ন্ত্রণের।

চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। আমনের মৌসুম চলার সময়ও দাম না কমে বেড়েছে। আমনের উৎপাদন এবার কম হয়েছে। সংরক্ষিত খাদ্যপণ্যের মজুদও কমেছে। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার চাল আমদানির অনুমতিসহ শুল্ক হ্রাস করেছে। ব্যবসায়ীদের কিছু সুযোগ-সুবিধাও দিয়েছে। এতে প্রতি কেজি চালের আমদানি মূল্য ২৫ দশমিক ৪৪ টাকা কমার কথা। অথচ, বাজারে এর প্রভাব নেই। উল্টো এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে অন্তত ৮ টাকা বেড়েছে। সিন্ডিকেটের কারসাজিই এর কারণ, তাতে সন্দেহ নেই। ক্যাবের মতে, চাল ব্যবসায়ীদের ফ্রিস্টাইল মনোভাবের কারণে চালের দাম কমছে না। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ চেয়েছে ক্যাব। চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মিল মালিক, আড়তদার, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরাই দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না কেন, সেটাই প্রশ্ন। বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি পরিবহন সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও কারো অজানা নেই। পরিবহনে চাঁদাবাজি আগের মতই সরবে ও প্রকাশ্যে চলছে। কৃষক পর্যায়ে কোনো পণ্যের দাম যা, ভোক্তা পর্যায়ে সেই পণ্যের দাম ১২ থেকে ১৫ গুণ বেশি হতেও দেখা যায়। একটি ফুলকপি বা বাঁধাকপির দাম গ্রামে দুই টাকার বেশি নয়। সেই কপিই ঢাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫/৩০ টাকায়।

এই যে দামের ব্যবধান, তার জন্য বার বার হাত বদল যেমন দায়ী, তেমনি পরিবহনে চাঁদাবাজিও দায়ী। কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। ভোক্তাও কম দামে পণ্য পাচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজরা সব খেয়ে ফেলছে। চালসহ যাবতীয় কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটবাজি বহাল আছে। চালের দাম, চিনির দাম, তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমেছে। আমাদের দেশে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চিনির দাম কমেনি। তেলের দাম আরো বেড়েছে। বলাবাহুল্য, সিন্ডিকেজবাজি ও চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে কোনো পণ্যের দামই কমবে না। বাজার স্থিতিশীল হবে না।

সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বৈরাচারের আমলে সিন্ডিকেটবাজি ও চাঁদাবাজি চলেছে; অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তা চলতে পারছে কীভাবে? দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, স্বৈরাচারের আমলে বিদ্যমান সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় আছে। কোথাও কোথাও সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের পরিবর্তন হয়েছে। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেটবাজদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে বিএনপির সিন্ডিকেটবাজরা।

বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করেছে। এখন তাদের জায়গায় চাঁদাবাজি করছে বিএনপি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সম্পর্কিত খবরাখবর প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা, আওয়ামী লীগের লোকেরা এতদিন যা করেছে, তা যদি এখন বিএনপির লোকেরা করে, তাহলে দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যাবে কীভাবে? বিএনপির শীর্ষ নেতৃপর্যায় থেকে সিন্ডিকেটবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদিতে লিপ্ত না হওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হলে দলের তরফে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এরইমধ্যে বেশকিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারপরও সিন্ডিকেটবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজিতে বিএনপির লোকদের নাম উঠছে কেন? বিষয়টি শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। সিন্ডিকেটবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি আগেও ছিল, এখনো আছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে এটা স্বীকার করলেই চলবে না। এসব অপকর্ম ও অপরাধ যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। এ সবের সঙ্গে যারাই জড়িত এবং তারা যে দলেরই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন উপদেষ্টার মতে, বাজারে তিন ধরনের সিন্ডিকেট আছে। যথা: আগের সরকারের সিন্ডিকেট। আগামী সরকারের সিন্ডিকেট। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট ভাঙার দায়িত্ব সরকারেরই। সরকারকে এ ব্যাপারে নিচেষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না। ব্যবস্থা নিতে হবে, তা যত কঠোরই হোক। গণস্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত