পবিত্র কোরআনে সূরা আল ইমরানের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। আপনারই হাতে আছে কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। লেখার শুরুতে কোরআনের আয়াতটি দিয়ে শুরু করলাম এই জন্য যে, গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার পথে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে লাখ লাখ নেতাকর্মীর ঢল নামে। প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায় নেতাকর্মীরা প্রিয় নেত্রীকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন। স্বয়ং খালেদা জিয়াও বোধ হয় আশা করেননি জনতার স্বতস্ফূর্ত এই ভালোবাসার সংবর্ধনা তিনি জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে পারবেন। রাজকীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সম্পূর্ণ মুক্ত পরিবেশে রাজকীয় সম্মানে চিকিৎসা নিতে একদিক লন্ডনে প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ঠিক একই সময় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ পরিবারের অন্যতম সদস্য যুক্তরাজ্য সরকারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক তদন্ত সংস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন জবাবদিহি করার জন্য। একদিকে শেখ মুজিবের পরিবারের প্রতি মানুষের ঘৃণা, বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা অন্যদিকে জিয়া পরিবারের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা এবং সম্মান।
ফ্যাসিবাদী শাসকের রোষানালে খালেদা জিয়ার দিন কেটেছে প্রাণঘাতি অসুস্থতা নিয়ে। স্বৈরাচারী হাসিনা একটি সাজানো দুর্নীতি মামলায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রথমে পাঁচ বছর এবং উচ্চ আদালতে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে খুব তাড়াহুড়া করে নিম্ন আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তিনি যেন ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। জলজ্যান্ত একটা মিথ্যা মামলা- তাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নির্জন কারাগারে পাঠানো হলো। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানসহ মোট ৬ জনের বিরুদ্ধে মাত্র ২ কোটি ১০ লাখ টাকার তহবিল তসরুপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু সঠিক তথ্য হলো; ২ কোটি ১০ লাখ টাকার একটি কানা কড়িও তসরুপ করা হয়নি বরং সেই টাকা ফুলে ফেঁপে এখন ১০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। বিষয়টি ছিল একেবারেই পদ্ধতিগত ভুলের কারণে সৃষ্ট। নিম্ন আদালতের সেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলে বিচারক এনায়েতুর রহিম সাজা আরো দুই বছর বাড়িয়ে সাত বছর করলেন। সহজেই অনুমান করা যায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কীভাবে আদালতকে কান ধরে উঠবস করাতেন। এটা নিয়ে তিনি সকাল-বিকাল যখন যেখানে পেরেছেন বক্তৃতা বিবৃতিতে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়েছেন।’ শেখ হাসিনার দেশের মানুষকে খুবই বোকা ভাবতেন। তিনি মনে করতেন তিনি যা বলবেন এটাই জনগণ বিশ্বাস করবে। আর সেজন্যই তিনি প্রতিনিয়ত একটি কথাই বারবার বলতেন। এটা ছিল তার বয়ান তৈরির কৌশল।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে এরইমধ্যে মামলা হয়েছে এবং সেগুলো বিচারাধীন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে বিশ্বময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে তার পরিবারের অর্থ কেলেঙ্কারি এবং লুটপাটের কাহিনী। শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যরা মিলে গত ১৬ বছরে কমপক্ষে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে। কেবলমাত্র রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চার বিলিয়ন পাউন্ড ঘুষ নিয়েছেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি এবং শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি আবার লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী। এখনো নীতি-নৈতিকতার মানদ-ে যুক্তরাজ্যের অবস্থান অতুলনীয়। যে কারণে সরকার দলের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও টিউলিপ সিদ্দিককে ছাড় দেয়া হচ্ছে না দুর্নীতির বিচারে। বিভিন্ন সময় লন্ডনে তিনি যে বাড়িগুলো কিনেছেন সে অর্থের উৎস জানার জন্য তদন্ত শুরু হয়েছে। টিউলিপ সিদ্দিকের চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেখান থেকে তাকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিনি আর ব্রিটেন ত্যাগ করতে পারবেন না। ছোটখাটো দুর্নীতি নয় মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের দুর্নীতি। এমন অপমান অপদস্ত হওয়ার দৃশ্য শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয় গোটা বিশ্ব অবলোকন করছে। এটাই শেখ হাসিনার এবং শেখ মুজিবের পরিবারের অর্থকড়ি লুটপাটের চিত্র। যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের একজন জননন্দিত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে অপমান অপদস্ত করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছেন আজ গোটা বিশ্ব দেখবে তারই ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক কীভাবে অপমান অপদস্ত হচ্ছেন প্রকৃত দুর্নীতি-অনিয়ম করার দায়ে।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিএনপির শত শত নেতাকর্মী গুম খুন এবং বিচারক বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী রাতের পর রাত ঘর ছাড়া থেকেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছর ধরে প্রবাসী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। অসংখ্য নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। বেগম খালেদা জিয়া নিরবে নিভৃতে এ সমস্ত অত্যাচার অবলোকন করে গেছেন। নেতাকর্মীদের পক্ষে কোনো বক্তব্য বিবৃতি দিতে পারেননি তিনি। আজ তিনি মুক্ত স্বাধীন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারছেন। তাকে বহন করার জন্য দোহার থেকে এসেছে রাজকীয় অ্যাম্বুলেন্স। এই যে সম্মান এই যে মর্যাদা তিনি ফিরে পেলেন সবই মহান আল্লাহর অপার মহিমা।
খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেসব প্রশ্নে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে শঙ্কাও ছিলো। দলের নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় তা হলো- ‘খালেদা জিয়া চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিকভাবে ফিরতে পারবেন কি না’ কিংবা ‘তার ফিরতে কোনো সমস্যা হতে পাওে কি না’। এর আগে, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তখন রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ আলোচনায় ছিল এবং দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছিলো। তখন অবশ্য দল তৈরির চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে সরে আসেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত পাঁচই আগস্ট আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার দল আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত। শেখ হাসিনা নিজেও ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়লেন যখন সরকার ঘনিষ্ঠ একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আরেকটি গোষ্ঠী ‘সংস্কার আগে নির্বাচন পরে’ এমন বক্তব্য দিচ্ছে।
সরকারে থেকে দল গড়ার প্রক্রিয়ার সমালোচনার বিপরীতে কেউ কেউ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দল গড়ার দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপিকেও ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে উল্লেখ করছেন, যা নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নানা জল্পনা শেষে খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারবেন তা এখনো নিশ্চিত নয়। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান- দুজনের কেউই দেশে না থাকাটা দলের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে তা সমানে দেখা যাবে। যদিও খালেদা জিয়া যাওয়ার আগে তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন। এবং সেই বৈঠকে নেতাকর্র্মীদের দিকনির্দেশনা ও কৌশল ঠিক করেছেন। কারণ খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না থাকলেও তার ঢাকায় থাকাটাই এক ধরনের ‘স্বস্তি’র বিষয় ছিল অনেকের মধ্যে। তবে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা দলের মধ্যে তেমন প্রভাব হয়তো পড়বে না। কারণ তিনি অসুস্থ হওয়ায় এবং কারাগারে থাকার সময়েও রাজনৈতিক বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা যেতো না। তখন হাজার মাইল দূর থেকে তারেক রহমানই এই দলকে সুসংগঠিত রেখে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘বিরাজনীতিকরণের’ আলোচনাটা আছে বলেই খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। আওয়ামী লীগ নেই। বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। সে কারণে খালেদা জিয়ার যে কোনো মুভমেন্টই রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। ১/১১ এর অভিজ্ঞতা বিএনপির নেতাকর্মীরা ভুলে যায়নি নিশ্চয়ই। বিএনপি এখন নির্বাচন চায়। অন্যদিকে সরকার ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে নানা কিছু বলছে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুজনেই দেশের বাইরে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট