বিপন্ন না হোক পারকি সমুদ্রসৈকতের জীববৈচিত্র্য
মো. তাহমিদ রহমান
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ একটি জীবন্ত ডেলটা, কৃষিপ্রধান দেশটির জীববৈচিত্র্য পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র সমৃদ্ধ। এই বাস্তুতন্ত্রে বাস করে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশকে সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্য দুটো রূপই উজার করে দিয়েছেন। সৈকতগুলোতে সৌন্দর্যের অন্যতম আধার লাল কাঁকড়া। সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া ৬,৭৯৩টি প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে লাল কাঁকড়া অন্যতম। সৈকতগুলোর ভেজা বালুচরে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার রাজত্ব। শুধুমাত্র সাময়িক মানসিক তৃপ্তির জন্য সেই রাজত্বে মানবকূল আঘাত হানছে নির্বিচারে। অবকাশ যাপনকে কেন্দ্র করে শীতকালে মানুষের উপদ্রব বেড়ে যায় সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে। কক্সবাজারের ইনানী, বাইলাখালী, হিমছড়ি, সেনাবাহিনী ক্যাম্প, শফিরবিল, মাদারবনিয়া, মনখালী, শাপলাপুর, জাহাজপুরা , সেন্টমার্টিন দ্বীপ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন এলাকা আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকত লাল কাঁকড়ার বিচরণ ক্ষেত্র।
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতগুলোকে যেভাবে টুরিস্ট স্পট করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে তার থেকে অনেকটাই আলাদা আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকত। পারকি সমুদ্রসৈকতের লাল কাঁকড়ার রাজ্যে বেড়াতে আসা অতিথিদের যেন লাল গালিচায় সংবর্ধনা, সম্মান ও আনন্দ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে সৌন্দর্যের প্রতীক লাল কাঁকড়ার দল। পারকি সমুদ্রসৈকতে সাদা সাদা দুটি চোখ এবং চোখের ওপরে লাল সুতোর মতো দুটি অংশ নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে বেড়ানো লাল কাঁকড়ার দল মুহূর্তেই রাঙিয়ে তুলে যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকের মন। বছর দশেক পূর্বে পারকির মতো অন্যান্য সমুদ্র সৈকতেও পর্যটকরা দেখতে পেতো হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। কিন্তু সমুদ্রসৈকতের তীরবর্তী এলাকায় যত্রতত্র হোটেল, মোটেল, কটেজ, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁ ও বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলে মানুষের অবাধ বিচরণে বিশেষ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিংবা বিচ বাইকে মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় লাল কাঁকড়ার প্রাকৃতিক বাসস্থানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পারকি সমুদ্রসৈকতের বালুচরে খানিক্ষণ দাঁড়ালে বোঝা যায় কাঁকড়ার রহস্যময় জীবন। সেটা কী রকম? সৈকতের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত যত দূর চোখ যায়, দৃষ্টিসীমায় দেখা যায় নানা নকশার আলপনায় আঁকা বিশাল বালুচর। ভেজাবালু দিয়ে ছোট ছোট বল বানিয়ে কাঁকড়ার দল সাজিয়ে রাখে সেই আলপনা। আলপনার ভেতরে-বাইরে গর্ত খুঁড়ে তৈরি করে কত শত বাসা। প্রজনন ও নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য কাঁকড়ার দল গর্ত খনন করে। গর্ত বা বাসার গভীরতা সর্বোচ্চ এক ফুট।
জোয়ারের পানিতে অসংখ্য বাসা বিলীন হয়, ভেঙেও যায়। তাতে সমস্যা হয় না কাঁকড়ার। কারণ সামনে যার গর্ত পড়বে, বাসাও তার হয়ে যায়। কার বাসায় কে ঢুকে পড়ছে, হিসাব নেই। লাজুক ও সদা সতর্ক ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া যখন সৈকতে দৌড়ে বেড়ায় সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য যেকোনো পর্যটকদের হৃদয় আনন্দে ভরিয়ে দেয়। লাল কাঁকড়া যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রসৈকত পারকির বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখছে তাই নয়, এটি ভেসে আসা কচ্ছপ, ডলফিন বা মাছ খেয়ে সমুদ্রসৈকতকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করছে। কিন্তু বর্তমানে ক্রমবর্ধমান পর্যটকদের উপদ্রবে পারকি সমুদ্রসৈকতেও লাল কাঁকড়ার প্রাকৃতিক বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে। কোলাহল-হইচই এর পাশাপাশি মানুষ ও ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে বিলীন হচ্ছে কাঁকড়ার বালুর বাসা ফলাফল হিসেবে লাল কাঁকড়াগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বায়োটার্বেশনের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক গুণাগুণের বা বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে খাদ্য চক্রে বিভিন্ন জীব-অনুজীব ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার মত পরিবেশ তৈরি করতে পারার কারণে লাল কাঁকড়া বায়োটার্বেটর হিসেবেও পরিচিত। লাল কাঁকড়া খাওয়া যায় না তাই অর্থনৈতিক মূল্য না থাকলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এই লাল কাঁকড়া রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তবে মানুষ না খেলেও লাল কাঁকড়া কুকুর ও গুইসাপের প্রিয় খাবার। এই কারণেও সমুদ্রসৈকতের নজরকাড়া লাল কাঁকড়া দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
সামুদ্রিক সম্পদ লাল কাঁকড়াকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। সৈকতের বালুচরে চলাচলের সময় লাল কাঁকড়াসহ অন্যান্য প্রাণীর যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লাল কাঁকড়ার আবাসস্থল সমূহ যেন কোনোভাবেই সংকটাপূর্ণ না হয় সে বিষয়ে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। লাল কাঁকড়া রক্ষায় সামুদ্রিক পরিবহন ও পর্যটন এবং সমুদ্রসম্পদ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করা জরুরি। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় বিচিত্র কর্মসূচি পালন করছে। এবার তাদেরই একজন শুদ্ধমতির বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা। তাই আমাদের দাবি সমুদ্রসৈকতের নজরকাড়া লাল কাঁকড়া ও অন্যান্য সৌন্দর্যবর্ধক উপকারী প্রাণীগুলো রক্ষা করতে উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা