ঢাকা ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এরদোয়ানের উত্থান কি মধ্যপ্রাচ্যে স্বস্তি আনবে

রায়হান আহমেদ তপাদার
এরদোয়ানের উত্থান কি মধ্যপ্রাচ্যে স্বস্তি আনবে

গত এক হাজার বছরের ইতিহাসে তুরস্কের রাজনীতিতে বড় ধরনের বাঁকবদলের ঘটনা আছে। তা হচ্ছে; ১২৯৯ সালে অটোমান বা উসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা তুরস্ককে ইতিহাসে নতুন এক জায়গা নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাস বলে, বিভিন্ন সময় অটোমানদের সঙ্গে ইউরোপের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিলই। অটোমানদের পতনের পর ১৯২৩ সালে ইউরোপের মিত্র কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে তুরস্ক। ঠিক তার প্রায় ১০০ বছর পরেই তুরস্ক আবার এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে। তুরস্কের নায়ক এরদোয়ান। এরদোয়ানের সঙ্গে ইউরোপের সরাসরি কোনো সংঘর্ষ না থাকলেও অটোমান-পরবর্তী শাসকদের মতো সম্পর্ক ততটা উষ্ণও নয়। সিরিয়ায় আসাদ শাসনের পতন হয়েছে। সেই সঙ্গে ইরানের দীর্ঘদিনের শঙ্কা সত্য হলো। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া জোটের অবসান ঘটল। আর তুরস্কের জন্য সুসংবাদ। আফ্রিকার হর্ন থেকে লেভান্ট ও আফগানিস্তান পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক মানচিত্র পুনর্গঠিত হবে বলে আন্দাজ করা যাচ্ছে। এরদোয়ান সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে তুরস্ক এখন আঞ্চলিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এ বাস্তবতার প্রভাব এখন অঞ্চলটির সমস্ত প্রধান শক্তিকে প্রভাবিত করবে। বিদ্রোহীদের অপ্রত্যাশিত বিজয়ে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অভিযানটি সংঘটিত হয়েছে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ এক সময়ে। গত ১৩ বছরে সিরিয়ায় এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরল। তুরস্ক বিদ্রোহীদের গোয়েন্দা তথ্য, দিকনির্দেশনা ও রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করেছে। সিরিয়ার সংঘাতের শুরুর বছরগুলোয় অনেক দেশ বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। সেই সমর্থন ছিল এলোমেলো।

তুরস্ক কিন্তু পুরো সময়ে সীমান্তের কাছে উত্তর-পশ্চিমের বিদ্রোহী এলাকা থেকে তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করেনি। ২০১৯ সালের পর অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলো। এ সুযোগে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর মধ্যেও তুরস্ক বিদ্রোহীদের পুনর্গঠন ও অস্ত্র সংগ্রহ নিশ্চিত করেছে। ইসরায়েলি হামলার ফলে হিজবুল্লাহ এবং লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে এই অঞ্চলে ইরান এখন তার সমর্থিত শক্তিকে জনবল ও সম্পদ সরবরাহে অক্ষম। ঠিক একই সময়ে রাশিয়া যুদ্ধে ব্যস্ত ইউক্রেনে। পুরো সমীকরণ বলছে যে আসাদ সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল। তুরস্কের এই সফলতা প্রতিবেশী ইরাকেও প্রভাব ফেলবে। দীর্ঘদিন ধরে ইরাকের উত্তরে নিজের উপস্থিতি বজায় রেখেছে তুরস্ক। তারা সেখানে ইরাকি কুর্দিদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, লক্ষ্যবস্তু করেছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে (পিকেকে)। সিরিয়ায় সুন্নি নেতৃত্বাধীন সরকারের উত্থান ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকায় তুরস্কের প্রভাব আরো শক্তিশালী করবে।

২০১৯ সালে ইসলামিক স্টেটের পতনের পর থেকে এই এলাকাগুলো ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া এই পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি ইরাকেও দেখা যেতে পারে। তুরস্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু সিরিয়া ও ইরাকেই সীমাবদ্ধ নয়। আঙ্কারার এই বাসনা আফ্রিকা, ককেশাস এবং মধ্য এশিয়াতেও বিস্তৃত। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিজয়ের চার দিন পর এরদোয়ান সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার মধ্যে ভূখণ্ডগত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করতে সফল মধ্যস্থতা করেছেন। লিবিয়াতেও তুরস্ক গভীরভাবে যুক্ত আছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকারের সামরিক সমর্থন দিয়ে তুরস্ক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব নিশ্চিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক উত্তর আফ্রিকার জ্বালানি ও শক্তি উৎপাদনের প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আফগানিস্তানেও তুরস্কের প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে। সেখানে ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর তাদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া ২০২০ সালের নাগর্নো-কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। এর মাধ্যমে ককেশাস অঞ্চলে ইরানের উত্তরের সীমান্তের কাছে তুরস্ক নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করেছে। তুরস্কের এই উত্থান আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে জটিল করে তুলেছে। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং তার মিত্রদের জন্য। ইরানের শিয়া পরিচয়ের বিপরীতে তুরস্কের সুন্নি পরিচয় সৌদি আরবের জন্য আরো সূক্ষ্ম ও ব্যাপক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। আর তা করতে গিয়ে সে অবস্থান নিয়েছে ইরানের শিয়া প্রভাবের বিরুদ্ধে। তুরস্কের উত্থান সৌদি আরবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এরদোয়ানের ইসলামপন্থি নীতি সুন্নি মুসলিম ও রাজনৈতিক ইসলামপন্থিদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। এর ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজতন্ত্রের একটি বিকল্পপন্থা তৈরির হুমকি অনুভব করছে সৌদি আরব। ইরাননির্ভর করেছে প্রক্সি শক্তির ওপর। তুরস্ক স্থানীয় সুন্নি শক্তিগুলোকে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে।

২০১১ সালের আরব বসন্তের মতো জনপ্রিয় আন্দোলন গুলোয় জড়িত হয়ে তুরস্ক ওই অঞ্চলের জনগণের সমর্থন পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক একটি প্যান-সুন্নি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সৌদি আরবের আঞ্চলিক নেতৃত্বের দাবি হয়েছে দুর্বল। ২০১২ সালে মিসরে তুরস্ক-সমর্থিত ইসলামপন্থি সরকারের উত্থানের স্মৃতি উপসাগরীয় দেশগুলোয় আবারও ফিরে এসেছে। গত দুই দশকে তেহরান থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ইরানের শিয়া জোট আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ২০১৯ সাল নাগাদ ইরান চারটি আরব রাজধানী বাগদাদ, দামেস্ক, বৈরুত ও সানা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল। তবে এই সম্প্রসারণ কৌশল ইরান বেশি বাড়িয়ে ফেলেছিল; যার অভিঘাতে ইরান এখন দুর্বল হয়ে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মতো আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। বিদ্রোহীদের বিজয় এবং তুরস্কের উত্থানের ফলে ইরান যে সহযোগিতা সরবরাহ করত হিজবুল্লাহ আর হামাসকে, তা ব্যাহত হয়েছে। লেবাননেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

হিজবুল্লাহ অভ্যন্তরীণ সংকট এবং ইসরায়েলের অব্যাহত সামরিক চাপের কারণে ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। ইরানের পতনে তুরস্কের লাভ হয়েছে। সিরিয়া প্রায় পাঁচ দশকের ইরানি মিত্রতা থেকে বেরিয়ে এসে তুরস্কের বন্ধু হতে যাচ্ছে। কেবল ইরানের পতনের ফলে তুরস্কের উত্থান ঘটেছে- এমন ভাবলে ভুল হবে। দেশটির সাহসী পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক রাজনীতিতে মৌলিকভাবে ভিন্ন কৌশলের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। ইরানের কৌশল ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও কেবল শক্তি প্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল তুরস্ক কাজ করেছে সামরিক হস্তক্ষেপ, কূটনৈতিক যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সমন্বয়ে। এই বহুমুখী পদ্ধতিই তুরস্ককে সফলতা দিয়েছে। এ অঞ্চলে তুরস্কের আধিপত্য অনেকের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। সিরিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের হিসাব-নিকাশ বদলেও দিয়েছে। তাদের এখন তুরস্কের মতো আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে। পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ তার ইসলামপন্থি সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন। আবার কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এগুলো তুরস্কের জন্য ইতিবাচক। প্রভাব কায়েম করতে গিয়ে ইরান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে মুখোমুখি হয়েছিল পরিস্থিতির।

সামনের দিনগুলোয় এ অঞ্চলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর ইরানকে ঘিরে আবর্তিত হবে না। সেই জায়গা নেবে তুরস্ক। তুরস্ক এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করবে কি না, এটা এখন আর প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো কীভাবে করবে? একসময়ের তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার এরদোয়ান বা তাঁর দলের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, এরদোয়ান সেই একই আচরণ করছেন ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে। রাজনীতির নাটকের চরিত্র বদল হয়েছে কেবল। কিন্তু আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মজার বিষয় হচ্ছে, উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বা ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, এরদোয়ান এখন নতুন সুলতান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

ধীরে ধীরে সব ক্ষমতাই নিজের হাতে নিয়ে নিচ্ছেন। অটোমান ইতিহাসনির্ভর সুলতান সুলেমান টিভি সিরিয়ালে দেখেছি, কোনো কিছুর ব্যত্যয় হলেই কথায় কথায় গর্দান চলে যেত। এখন হয়তো কথায় কথায় গর্দান যায় না। তবে কথায় কথায় জেলে ঢোকানো হয়। ইরানেরও একই অবস্থা। বিরোধী মতকে কোনোভাবেই বিন্দুমাত্র জায়গা দেয়া হয় না। চীনের অবস্থাও ভিন্নতর কিছু না। কিন্তু পশ্চিমারাও আসলেই বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র চায়, নাকি তাদের মিত্রদের ক্ষমতায় বসাতে চায়, এটাও ভেবে দেখার বিষয়। উত্তর কোরিয়া হয়তো এখন কিছুটা ছাড় পেতে পারে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাপ থেকে। বিশেষ করে ট্রাম্প-কিমের বৈঠকের পর। বস্তুত, সারা বিশ্বেই যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় রেখে বা অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তি উসকে দিয়ে কোনো দেশেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। শুধু তুরস্ক কেন, ইরান, চীন বা উত্তর কোরিয়া, বিভিন্ন দেশেই পশ্চিমারা একই কায়দায় তথাকথিত গণতান্ত্রিক মিত্রদের ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছেন।

তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সামরিক বাহিনীকে উসকে দিয়েছে ক্ষমতা দখলের জন্য। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমাদের এই উচ্চকিত হওয়া এক বিশাল ভুল ও ভ্রান্তনীতি। এতে করে কোথাও পশ্চিমাদের প্রত্যাশিত শক্তি ক্ষমতায় আসবে না বা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায়ও থাকবে না। গণতন্ত্রের সঠিক বিকাশও হবে না। গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ওই দেশে নাগরিকদের হাতেই ছেড়ে দেয়া। নতুবা পশ্চিমাদের এই ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যারা টিকে যান, তারা ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থেই আয়াতুল্লা আলী খামেনি, এরদোয়ান, সি চিন পিং বা কিম জং-উনের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হন। জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তাকে এসব শাসক ক্ষমতায় টিকে থাকার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। আর মিসরের মোহাম্মদ মুরসির মতো যারা ঝড়ে উড়ে যান, তাদের শূন্যতা পূরণ করে জেনারেল আবদেল সিসির মতো সামরিক স্বৈরাচাররা। বস্তুত দুটির কোনোটিই কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত