সন্তান সুখের বিকল্প। সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফাইটিং থাকলেও নারী ও পুরুষের জীবনের লাইটিংটা মূলত সন্তান আগমনের মাধ্যমেই ঘটে। বাইরের নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাবা-মা ঘরে ফিরে সন্তানের মুখ দেখলে, কথা শুনলে এবং পাশাপাশি বসলে কোন দুঃখ-কষ্টই আর অবশিষ্ট থাকে না বরং জীবন চাঁদের পাশে রাতের তারার মতো সুন্দর হয়ে ওঠে। তবে কর্মসূত্রে যাদের সন্তান থেকে দূরে থাকতে হয় কিংবা সন্তানকে যাদের থেকে দূরে রাখতে হয়- সন্তান ছাড়া থাকার দুঃখ তারাই বোঝে। বাবারা সন্তান ছেড়ে দূরে থাকতে পারলেও মায়েরা সন্তানকে দূরে রেখে না পারে খেতে আর না পারে ঘুমাতে। জীবনটা তখন অকল্পনীয় দুর্বিষহ মনে হতে থাকে। সন্তান থাকার পরেও যে মাকে একা থাকতে হয় তাঁর জীবনের শূন্যতা পৃথিবীর বিকল্প কোনো পূর্ণতা দিয়ে পরিপূর্ণ করা যাবে না। সন্তানবিহীন মা ভাবাটা যতটা সহজ বাস্তবতা ঢের কঠিন। অথচ বাস্তবতার কাছে প্রায় প্রত্যেককে হারতে হয়। সন্তানকে মা-শাশুড়ির কাছে রাখতে হয় কিংবা বাইরের লোকের কাছে পালতে দিতে হয়। মা যেভাবে সন্তানকে যত্নে পোষে সেভাবে পৃথিবীর আর কেউ পারে? পারার কথা? সন্তান কেমন আছে, কী করছে, খেতে পেরেছে কিংবা কান্না করছে কি না- এই ভাবনায় মায়ের সময়টা অস্থির কাটে। সন্তানকে দূরে রেখে কাজে মন বসাতে ক’জন মা পারে? আচ্ছা, মা ছাড়া সন্তান কেমন থাকে? যে মা সন্তানকে কাছে পায় না- সে সন্তানের মতো অসহায় শিশু সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেও নেই। মায়ের কাছে যত আব্দার করা যায়, মায়ের শরীরের ঘ্রাণে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর আর কারো কাছে নাই তো। যে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের গল্প হয় না, গন্ধ পায় না কিংবা হাত ধরে হাঁটতে শেখে না তাদের মধ্যে দূরত্ব থেকে যায়। ভিডি কলের দেখাদেখিতে সে আফসোস আরো বাড়িয়ে দেয়। সন্তানকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমাতে পারার তৃপ্তি আর কিছুতে নাই। বাবা-মা কোটি দুঃখ সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কবর দিতে পারে। চরম হতাশার মাঝেও কেবল সন্তানের স্বার্থে বাঁচতে পারে। শিশু সে শিশুকে দূরে রেখে বাবা-মাকে কেন আলাদা থাকতে হয়? সন্তান ছেড়ে দূরে থাকার প্রত্যেকের কি যৌক্তিক কারণ আছে? দু’জনকেই চাকরি করতে হবে- এমন প্রয়োজনীয়তা সবার ক্ষেত্রে কী আদৌ আছে? সেক্রিফাইজ মূলত কে করবে- এমন বিতর্কে সবাই আত্মপরিচয় বিজয় করতে চায়! অথচ হেরে যায় সন্তান। আদর-ভালোবাসা বঞ্চিত হয়ে একপ্রকার অনাথের মতোই বাড়ে দুধের শিশুটি। বাবা-মায়ের জীবনের শেষ বেলাতে কিংবা সন্তানের বুঝতে পারার বয়সে যখন শৈশব নিয়ে স্মৃতিচারণ করবে তখন বাবা-মায়ের পক্ষ সন্তানকে কৈফিয়ত দিতে পারবে? জীবনে কিছুটা কম সম্পদ হোক, সচ্ছলতায় ঘাটতি থাকুক তবুও সন্তান বাবা-মায়ের কোলে-পিঠে থাকুক। যে সন্তান প্রয়োজনের সময় বাবা-মাকে কাছে পায়নি, সেই বাবা-মায়ের প্রয়োজনের সময় যদি সন্তাকে কাছে না পায় তবে সমাজ কি সন্তানকে দায়ী করবে? বৃদ্ধাশ্রম বাড়িয়ে যাওয়া উচিত। পিতামাতার ভবিষৎ ততটা সুখকর হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না। এভাবে সম্পদের বিকল্প দিয়ে সন্তানের শৈশবকে বঞ্চিত করার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কোনো শিশুর শৈশব-কৈশোর দুবার ফেরে না। কোনো বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি হৃদয়ের টান কখনো কমে না! সন্তানকে দূরে রেখে আমরা যারা অর্থসম্পদ, যশ-খ্যাতির পিছনে হন্যে হয়ে ছুটছি এবং অন্য যেসব উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ছুটছি তা বিলকুল ব্যর্থ হবে- যদি সন্তান বাবা-মায়ের উদাসীনতায় বিপথে যায়। আত্মপরিচয় এবং আত্মনির্ভরশীলতার চেয়েও সন্তানের স্পর্শ এবং সন্তানকে আদর-যত্নে বড় করা অনেক বেশি জরুরি। বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের যে হক তা যদি অনাদায়ী থেকে যায় তবে স্রষ্টার কাছে আসামির বেশে দাঁড়াতে হবে। যে সন্তান বাবা-মায়ের ছোঁয়া না পেয়ে কান্নাকাটি করে ঘুমাতে যায়, সন্তানকে দূরে রেখে ঘুমাতে যাওয়া বাবা-মা এর ব্যথা বোধহয় উপলব্ধি করে!