ঢাকা ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুপ্ত জ্ঞানের প্রতিভা বিকাশে বইমেলা

ওসমান গণি
সুপ্ত জ্ঞানের প্রতিভা বিকাশে বইমেলা

দিন-মাস-বছর ঘুরে আবারো কিছুদিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাঙালি জাতির প্রাণের মেলা- বইমেলা। এই বইমেলাকে উৎসবমুখর করে তুলতে মেলার আয়োজকরা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। দেশের নবীন-প্রবীণ লেখকরা তাদের লেখা বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী বই- কবিতা, গল্প উপন্যাসের বই ইত্যাদি লেখে প্রস্তুত করে রেখেছেন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছেন। তবে এবারে বইমেলা অন্যান্য বছরের চেয়ে আরো বেশি উৎসবমুখর হবে বলে দেশবাসী মনে করেন। রাজনৈতিক সরকারের পটপরিবর্তনের পর বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ মেলার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের কাছে মডেল হিসাবে দাঁড় করাবেন বলে লেখক, পাঠকসহ দেশের সকল শ্রেণীপেশার মানুষ আশাবাদী। বই হচ্ছে মানুষের সেই বন্ধু যার জাগতিক কোনো শরীর নেই; কিন্তু সে ধারণ করতে পারে সমগ্র মহাবিশ্বকে। যার পরতে পরতে লুকায়িত আছে এক অনন্ত অসীম ঐশ্বর্য। যে সেই অপার ঐশ্বর্যে ডুব দিয়েছে একাগ্র সাধনায়, সে পেয়েছে বইয়ের নিজস্ব সত্তার আসল অকৃত্রিম ভান্ডার, সে হয়ে উঠেছে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য প্রেমিক।

ব্যক্তি জাগতিক রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ নেই, কিন্তু তাদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে আমার আলাপ করার সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তি বিভূতিভূষণ, বার্ট্রান্ড রাসেল, লালন ফকির- এমন সবার সঙ্গে, সবার দর্শনের সঙ্গে আমাদের কথা বলার একমাত্র পথ হচ্ছে বই। তাদের রচিত বই তাদের চিন্তা, দর্শন তৎকালীন সময়ের সমাজ, জীবন সব বিষয় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে, যা আমরা শুধু তাদের রচিত বইয়ের মাধ্যমেই পেতে পারি। সেজন্য বইয়ের গুরুত্ব আমার কাছে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক।

বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আমাদের আবেগিত মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা অমর একুশে বইমেলা। আবহমান কাল থেকেই আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে, তন্মধ্যে অমর একুশে বইমেলা হলো সর্বোকৃষ্ট মেলা; যেখানে জ্ঞানের বিনিময় ঘটে বইয়ের মাধ্যমে। বইপড়া ব্যতীত জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ নেই। তাই জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। বই হলো মানুষের জাগতিক, মনোস্তাত্মিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে উপনীত হওয়ার প্রধান সোপান। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। আর শিক্ষার জন্য বই-ই আলোকিত জগতের দিশারী।

বই মানুষ পড়তে চায় না, তার কারণ কি? বই মানুষ কেন পড়বে বই? পড়লে কী লাভ হবে? এরকম নানা প্রশ্ন অজ্ঞাণী মানুষের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে, এসব অবান্তর প্রশ্ন থেকে মানুষকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজে বই পড়তে হবে পরিবারের ছোট বড় সকলকে বই পড়ায় আগ্রহী করে চলতে হবে। মানুষ কেন বই পড়ে? একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বই পড়ার ১০টি কারণ বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্মৃতিশক্তি বাড়ানো, বলার দক্ষতা বৃদ্ধি, চিন্তার স্বচ্ছতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা, মনঃসংযোগ, লিখবার দক্ষতা, বিনোদনের জন্য, অবসাদ কাটানো ইত্যাদি কারণে বই পড়ে মানুষ। কিন্তু সবচেয়ে প্রথমে যে বিষয়টিকে তারা রেখেছে সেটি হচ্ছে- মানসিক উদ্দীপনা। বই পড়লে মানুষ মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়। সেই কারণেই বই পড়ে। যখন কেউ বই পড়ে তখন কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। যা বিশ্বাস করত না, তা বিশ্বাস করে অনুপ্রাণিত হয়, বইয়ের প্রাণহীন পাতাগুলো মানুষের মনের স্পর্শে যেন প্রাণ পায়, আর সে কারণেই আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগেও বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি মানুষ।

বইমেলা যেকোনো জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় ও ঘনিষ্টতর হবে, সেই মানুষ তত উন্নত চিত্তের অধিকারী হবে। বিশ্বের যত জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিপ্লবী এবং স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, প্রত্যেকের জীবনই বইয়ের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। বিশ্বের ইতিহাসে তাকালে দেখা যায়- কবি, লেখক, পাঠক এবং দর্শনার্থীর পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠে বইমেলা প্রাঙ্গন। নতুন বইয়ের তাজা ঘ্রাণে আমোদিত স্টলে স্টলে বইকেনা, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান, বই হাতে নিয়ে মোবাইল ফোনে ছবি ওঠানোর ধুম, ব্যস্ত কবি-লেখকদের অটোগ্রাফে প্রশংসা ও আশীর্বচনে আসলেই বাঙালির প্রাণ চঞ্চল না হয়ে পারে না। অমর একুশে বইমেলার পথিকৃৎ হিসেবে যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তিনি হলেন মুক্তধারা ও পুঁথিঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা। যিনি সর্বপ্রথম আনুমানিক ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায় মাটিতে চট বিছিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ৩০ থেকে ৩২টির মতো বই বিক্রি শুরু করার মধ্যদিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এরপর থেকে তিনি একাই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বইমেলা চালিয়ে যান। তিনি ১৯৭৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বই বিক্রির অনুমতি লাভ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুনমাত্রা লাভ করতে সক্ষম হন, ১৯৭৬ সালের দিকে অন্যান্যরাও অণুপ্রাণিত হয়ে তার সাথে যোগ দিতে শুরু করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে সরকার একে পূর্ণাঙ্গ বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন।

১৯৭৯ সালে বইমেলার সাথে সম্পৃক্ত হয় চিত্তরঞ্জণ সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’। ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য সরকারিভাবে আইন পাস করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ হওয়া সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেক শহীদদের স্মরণে নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মহাসমারোহে চলেছে গ্রন্থমেলার পথচলা। শুরু থেকে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজকে কেন্দ্র করেই বইমেলার বিস্তৃত ছিল, ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্প্রসারণ করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশনা সংস্থা তাদের নিজস্ব বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে; তন্মধ্যে ভারত, রাশিয়া ও জাপানসহ আরো অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণ লাখ করা যায়।

বইমেলায় বইয়ের পাশাপাশি স্থান করে নিচ্ছে বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা, যেমন- মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, সিডি, ডিভিডিসহ আর কত ইন্টারনেট সংস্থা। পাশাপাশি লেখক বলছি কর্নার, তথ্যকেন্দ্র ও নিরাপত্তাদানকারী সংস্থাসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এ সময় বিভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংস্থাগুলো সাড়ম্বরে আয়োজন করে কবিতা পাঠের আসর, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রেডিও টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের কর্মীরা সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে বইমেলার অনুষ্ঠানাদি। বাংলা একাডেমির আয়োজনে এ গ্রন্থমেলা দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। আর এমন একটি নক্ষত্রময় প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে।

বইমেলায় পরিচয় ঘটে অনেক অজানা, অচেনা লেখকের সঙ্গে। গড়ে উঠে সেতুবন্ধ, হয় ভাব ও মতের বিনিময়। আজকাল ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থানীয় লেখক, পাঠকদের প্রাণের দাবি এখানে পূরণ হয়। দেশের খ্যাতিমান, চেনা-জানা লেখকদের পাশাপাশি অজপাড়া গাঁয়ের অখ্যাত, অপরিচিত লেখকরাও চেষ্টা করেন এ মেলায় এসে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে। তাদের লেখনী তুলে ধরতে। মেলা উপলক্ষে কারো কারো বই প্রথম প্রকাশনার মুখ দেখে। হয় মোড়ক উন্মোচন। এভাবে বেরিয়ে আসেন অনেক প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাবান লেখক। হয় অনেকেরই লেখক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ।

আধুনিক নেট কেবলের যুগে যদিও হারিয়ে যাচ্ছে- সৃজনশীল বইয়ের আবেদন ও পাঠাভ্যাস। তবু বইমেলা যেন এখনো জাগিয়ে রেখেছে সৃজনশীল সাহিত্য আর লেখক কবিদের মনের সুপ্ত বাসনাকে। তবে এ মেলা থেকে আমাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হচ্ছে, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। বইমেলা মানে লেখক, প্রকাশক, পাঠক- এ তিন শ্রেণির মানুষের মেলা। এ তিন শ্রেণির প্রত্যেকের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন জড়িয়ে রয়েছে এ মেলার সঙ্গে। তাই তাদের প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এ মেলার সার্থকতা। একজন লেখক সব সময় চান তার সেরা লেখাটিই মেলায় উপস্থাপন করতে। আর এ ব্যাপারে সহায়ক মাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একজন প্রকাশক। বইকে সুন্দর, নির্ভুল ও পরিপাটি করে উপস্থাপনের দায়িত্ব একজন প্রকাশকের। কিন্তু বিগত দিনে দেখা গেছে, নিম্নমানের কাগজ এবং ভুল বানানের কিছু কিছু বই লেখক, পাঠক উভয়ের জন্য বিরক্তিকর, ক্ষতিকর ও আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের বইমেলায় যাতে প্রবেশ না করে, সেদিকে কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ বাইরে সুন্দর আর ভেতরে অন্তসারশূন্য। এমন বইমেলা কারোরই কাম্য নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত