ঢাকা ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ক্ষমতার পালাবদল নয়, দরকার নৈতিক সংস্কার!

রাজু আহমেদ
ক্ষমতার পালাবদল নয়, দরকার নৈতিক সংস্কার!

কল্পনা করুন এমন দু’জন চাকরিজীবীর কথা, যাদের একজন এমন কোনো চাকরি করে যেখানে চাইলেও আর্থিক অসততায় জড়ানোর সুযোগ নেই এবং অন্যজনের বিস্তৃত আর্থিক অনিয়ম করার তথা ঘুষ, দুর্নীতি করার সুযোগ আছে। আর্থিক অসততার সুযোগ নেই; কিন্তু মনে মনে অসততা লালন করে কিংবা আর্থিক অসততার সুযোগ আছে; কিন্তু লোভকে নিবৃত্ত করে সৎ থাকার চেষ্টা করে- দু’জন মানুষের মধ্যে আল্লাহ সৎ মানুষটিকেই বেশি পছন্দ করেন। আর আল্লাহ যাকে অপছন্দ করেন তার আয় মোটা হলেও, চেয়ার চওড়া হলেও কিংবা সম্পদের পাহাড় থাকলেও তা বৃথা। যৌবনে ঘুষ-দুর্নীতি করে বার্ধক্যে দান-খয়রাত করবে, মসজিদণ্ডমন্দিরে হাজিরা দেবে এবং শেষবেলায় সাধুর বেশ ধরলে অতীত মাফ হবে? মহান আল্লাহ দয়াময় হিসেবে আল্লাহর হক ক্ষমা করে দিতে পারেন; কিন্তু বান্দাহর হক ঠকালে সেটা মাফ করার দায়িত্ব প্রভূ নিজের কাছে রাখেননি। যাকে ঠকিয়েছেন তার কাছে ঠেকে থাকতেই হবে।

স্রষ্টা এমন কোন জীবিকা জুটিয়ে দিয়েছেন যেখানে সৎ থাকা তুলনামূলকভাবে সহজ- এটা বান্দাহের প্রতি রবের দয়া। যে পেশায় সৎ থাকতে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সহজ জিহাদ করেই সততা ধরে রাখা যায় সেখানে নিজেকে জড়ানো উচিত। অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে সর্বাধিক হালাল পথে জীবিকা অন্বেষণ করা আবশ্যক। কবরের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকের ভাবা উচিত, অন্যায়ভাবে স্তূপীকৃত এত এত সম্পদ, কারো হক ঠকিয়ে আদায় করা ক্ষমতা কিংবা কারো অধিকার বঞ্চিত করে অর্জিত দীর্ঘশ্বাস- মানবমুক্তির উপকারে আসবে নাকি বাঁধার সৃষ্টি করবে? কত ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সম্পদশালী জমিদার কিংবা রূপনগরের চরিত্র মাটির সাথে মিলোমিশে একাকার হয়ে গেছে। হাড়-মাটি আলাদা করার সাধ্যও অবশিষ্ট নেই। কে কোনো কবরে ঘুমিয়ে আছে, সেসবরেও হদিস নেই। পরিচয়বিহীন মানুষগুলোর এককালে দুনিয়াতে কম দাপট ছিল না। অথচ তাদের রেখে যাওয়া সম্পদ যারা ভোগ করছে, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের নামধাম পর্যন্ত জানে না।

জীবনে সৎ থাকা খুব জরুরি। আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাই সততার একমাত্র নির্ণায়ক নয়। চরিত্রের সততা, জবানের সততা কিংবা দায়িত্ব পালনের সততার সম্মিলিত রূপেই একজন মানুষ ভালো মানুষ হয়ে ওঠেন। কারো অভিশাপ-দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, উদ্দেশ্য আদায়ের জন্য কাউকে জিম্মি করে কিংবা কারো প্রাপ্য অনাদায়ী রেখে কাউকে কোনোভাবে মানসিক বা শারীরিক হয়রানি করলে- সেটাই অসততা। সৎ মানুষ মানুষের মন-মগজ থেকে সম্মানিত হন। যেহেতু সমাজে সৎ মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন, তাদের বিচরণ বিক্ষিপ্ত সেজন্য সমাজে অসৎ মানুষগুলোর জয়জয়কার। সমাজ সঠিক পথে চলছে কি-না, সেটা বোঝার প্রধান আলামত হচ্ছে সেই সমাজে সৎ মানুষদের অবস্থান বিশ্লেষণ করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে সৎ মানুষগুলো নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়সমূহে নেই। এমনকি সৎ-নীতিবান মানুষেগুলো প্রচারেরও বাইরে। এখানে কতিপয় অসততার গল্পের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও সততার পুরস্কার পাওয়ার সৌভাগ্য খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। সমাজের পঁচনে, সামাজিক শৃঙ্খলা ধ্বংসে এবং ঘুষ-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে ভালো মানুষদের দায়িত্বশীল অবস্থানে না থাকাই প্রধানত দায়ী।

সমাজের প্রশ্ন হচ্ছে, চাকরিতে আয় কত? ব্যবসায় মুনাফা কেমন? সুদের হার কত? বেতনের সাথে সঙ্গতিহীন আয় নিয়ে প্রশ্ন করতে দায়িত্বশীলরা ভুলে গেছেন। উৎপাদিত ফসলের দামে কৃষক মাঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে অথচ বাজারের ফড়িয়ারা ক্রেতাদের পকেট কাটছে ভয়ঙ্কর জাগরণে। মহাজনের সুদের কষাঘাতে গরিব আরো গরিব হচ্ছে। এসব নিয়ে সমাজস্থদের মাথাব্যথা নেই। অন্যের ছেলে-মেয়েদের অবৈধ আয় দেখে ইসলামণ্ডঈমানের বয়ান দিবে অথচ নিজে এবং নিজের ছেলেমেয়ে অবৈধ অর্থ কামাই করে সম্পদের কুমির হয়েছে- সে বিষয় একটি কথাও নেই। যে সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি বেতনের মত স্বাভাবিক বিনিময়ের স্থান দখল করে সে সমাজ আদতে পঁচে গেছে- এটা বলতে ভাড়া করে বিশেষজ্ঞ আনার দরকার নেই। সমাজে খুব অল্প মানুষ পাওয়া যাবে যারা সৎভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে। তবে আশার কথা কেউ কেউ এখনো ধর্মীয় অনুশাসন মেনে, দেশপ্রেমের মূল্যবোধ ধারণ করে এবং বিবেককে বিচারক বানিয়ে সমাজের নানা প্রতিকূলতা সহ্য করেও হালালভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিত্য সর্বোচ্চ সংগ্রাম করছে।

সুযোগ বারবার আসে না। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান জাতিকে শুধরে যাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছে। এই বিপ্লব যাতে বেহাত না হয়। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর এবং লুটপাটকারীদের অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ক্ষমতার পালাবদলের চেয়ে জাতির বেশি দরকার নৈতিক সংস্কার! জনতার মানসিকতা বদলানোর জন্য যা যা করা দরকার তা ছাত্র-জনতার ম্যান্ডেডধারী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে ব্যর্থ হলে সেটা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং পরিতাপের বিষয় হবে। এবার যদি সংস্কার না হয় তবে এই বাংলাদেশের ভাগ্য ভূমিকম্প ছাড়া আর কোনোদিন বদলাবে- সেই আশাবাদ কেউ রাখে না। ঘুষখোরদের চিহ্নিত করে বিদায় করতে হবে, অসৎ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য রুখে দিতে হবে এবং ভেঙে ফেলতে হবে যাবতীয় সিন্ডিকেট। শয়তানের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের জিম্মি দশা থেকে দেশ ও দশ মুক্তি চায়।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে যে অসম বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে তা ঘুঁচিয়ে আনার উপযুক্ত মওসুম চলতে যাদের জীবনের বিনিময়ে, যাদের রক্ত ও ত্যাগের ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে, তাদের সেই জীবনের উৎসর্গের প্রতি সম্মান রেখে যদি নিয়মের পরিবর্তন, রীতির বদল না ঘটে তবে ঘুষ-দুর্নীতি, ফ্যাসিবাদণ্ডবৈষম্য নতুন মোড়কে, নতুন নতুন হাতের স্পর্শে পুরাতন বোতলে ফেরত আসবে।

শুধু ক্ষমতা বদলের এমন ধারাবাহিকতা চললে জাতির ভাগ্য বদলের অবকাশ আর কোনোদিন হবেই না তবে। নিয়মের পরিবর্তন এবং আইনের সফল প্রয়োগ দরকার। জাতির ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে আমরা আমাদের ভাগ্য বদলাতে পারি- যদি চাই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত