ব্যক্তিমানুষের আত্মপরিচয় বহুমাত্রিক এবং নানা স্তরবিন্যাসে গঠিত। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, পেশা, আঞ্চলিকতা, এমনকি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এসব নানা বিষয়ের ভিত্তিতে একজন ব্যক্তির পরিচয় তৈরি হয়। পরিচয়ের প্রতিটি স্তরই তার জীবনের স্বতন্ত্র এক দিক উন্মোচন করে। এই বহুমাত্রিক পরিচয়ের ভেতরে জটিল একটি আন্তঃসম্পর্ক কাজ করে, যা একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রা, চিন্তাভাবনা ও সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের আত্মপরিচয়ের এই বহুমাত্রিকতার মাঝেও, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী সামষ্টিক ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয় হয়ে ওঠে, যা যে কোনো দেশের নাগরিকদের মধ্যে ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তোলে। এটি এমন এক সামষ্টিক পরিচয়, যা ব্যক্তির অন্যসব পরিচয়কে ছাপিয়ে বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে মানুষকে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে জাতীয় পরিচয়ের সূত্রে একত্রিত করে। এই পরিচয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে ধারণ করা হয়, অন্যদিকে তেমনই একটি অভিন্ন জাতীয় লক্ষ্য ও আদর্শকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে তোলা হয়। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ কোনো একক পরিচয়ের উপর জোর দেয় না; বরং এটি বহুমাত্রিক পরিচয়ের সম্মিলিত রূপ, যেখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয়ের পাশাপাশি বৃহত্তর সামষ্টিকতার অংশ হিসেবে নিজেকে অনুভব করে। তাই, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ কেবল একটি পরিচয় নয়, এটি নাগরিকদের মধ্যে সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার এক অনুপ্রেরণা ও অঙ্গীকার।
স্বাধীনতার পর থেকেই জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কি হবে, এ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। আমাদের বোঝা দরকার যে, বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ কখনো কখনো তার নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক বা ধর্মতাত্ত্বিক পরিচয়কে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নাগরিকদের এসব পরিচয়ের ভিন্নতা স্পষ্ট। এ দেশের মানুষের রয়েছে বৈচিত্র্যময় নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় পরিচয়। পরিচয়ের এই বহুত্বকে অস্বীকার না করে বরং মেনে নিয়েই আমাদের রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে এমন এক বাংলাদেশি পরিচয়, যা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও সামষ্টিক স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটায়। এই জাতীয়তাবাদকে মজবুত করতে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’- এর ধারণা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে আমরা খুঁজে দেখতে চাই, কীভাবে ব্যক্তিগত বহুমাত্রিক পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে এবং আমাদের জাতি হিসেবে ঐক্যের পথে এগিয়ে নিতে পারবে। ব্যক্তিমানুষের বহুমাত্রিক পরিচয়ের স্বাভাবিকতাকে স্বীকার করা জরুরি। একজন ব্যক্তির ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত কিংবা পেশাগত পরিচয় তাকে যে বৈচিত্র্যময় সত্তায় রূপান্তরিত করে, তা স্বীকার করার মানে তার মানসিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। একইভাবে, একটি সমাজ বা জাতি যখন তার অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে, তখন সেটি তার একীকরণ প্রক্রিয়াকে আরো সমৃদ্ধ ও দৃঢ় করে। জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময়তা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি আমাদের ঐতিহাসিক গৌরব এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির প্রমাণ। কিন্তু একে অস্বীকার করা বা অবহেলা করা জনগণের মাঝে বিভাজন ও ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দেয়। জাতি হিসেবে বহুমাত্রিক পরিচয়কে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা ও তাকে আলিঙ্গন করা এমন একটি চেতনা তৈরি করতে পারে, যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহাবস্থান অগ্রাধিকার পাবে। এটি বুঝতে পারলেই জাতিসত্তার পরিচয়ের ভুল ব্যাখ্যা, অপ্রয়োজনীয় তর্ক-বিতর্ক এবং কুতর্ক দূর করা সম্ভব। এর ফলে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদকে এমন একটি কাঠামোয় স্থাপন করা সম্ভব, যা ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পরিচয়ের মধ্যকার সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে সক্ষম। এই সেতুবন্ধনের প্রধান উপাদান হতে পারে শিক্ষা। একটি উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা তরুণ প্রজন্মকে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে শেখায় যে, আমাদের ভিন্নতা কোনো বাধা নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের শক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান। ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই আমরা জাতি হিসেবে আরো সুদৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারি।
ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, একজন ব্যক্তির পরিচয় বহুস্তরীয় ও চলমান। এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া, যা সময়, পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার সাথে বিকশিত হয়। জার্মান বংশোদ্ভুত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসনের (১৯০২-১৯৯৪) আত্মপরিচয় তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্যক্তি তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে এবং তা তার ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক অবস্থানের অংশ হয়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি একসঙ্গে একজন কন্যা, একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন শিক্ষক, একজন নাগরিক এবং একজন সংস্কৃতিপ্রেমী হতে পারেন। এগুলো তার ব্যক্তিক সত্তার ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়। এই বহুমাত্রিকতা ব্যক্তিক পরিচয় অন্যের সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপ্তিকে তুলে ধরে এবং তাকে আরো সংবেদনশীল ও সহযোগিতামূলক করে তোলে। এক্ষেত্রে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ আমাদের দেখায় যে, বহুমাত্রিক পরিচয় কোনো বিভাজনের কারণ নয়; বরং এটি একটি শক্তি এবং সম্পর্কিত হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করে। ব্যক্তি যখন তার ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের সম্মিলন ঘটায়, তখন সে কেবল নিজের সত্তাকে সমৃদ্ধ করে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এই ব্যক্তিক আত্মপরিচয়ের বহুমাত্রিকতার ইতিবাচক দিকগুলোকে চিহ্নিত করা এবং প্রশংসিত করা সম্ভব। এমন একটি শিক্ষা যা ব্যক্তি ও জাতির পরিচয়ের বহুস্তরীয় চরিত্রকে তুলে ধরে, মানুষের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির বোধ জাগিয়ে তুলতে পারে। বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাকে এমনভাবে নকশা (ডিজাইন) করা উচিত, যা ব্যক্তিক পরিচয়ের বহুমাত্রিকতাকে সামষ্টিক কল্যাণে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের সাথে সংযুক্ত করে। এটি ব্যক্তি ও জাতি উভয়ের জন্য একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে, যেখানে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ শুধু একটি আদর্শ নয়, বাস্তবতার প্রতিফলন হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ ও ঐক্যের ধারণাকে জনশিক্ষার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা না গেলে দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ মানে কোনো একক পরিচয়ের প্রাধান্য নয়; বরং এটি একটি সর্বজনীন পরিচয়ের ছাতা, যা দেশের সব নাগরিকের বৈচিত্র্যময় পরিচয়কে মেনে নিয়ে তাদের একত্রে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। এটি এমন একটি কাঠামো তৈরি করে, যেখানে ব্যক্তিগত নানা পরিচয়ের চর্চা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে বরং তা সমৃদ্ধ করে।
অ্যাংলো-আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের (১৯৩৬-২০১৫) ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (ইমাজিন্ড কম্যুনিটিজ, ১৯৮৩) ধারণা অনুযায়ী, একটি জাতি এমন একটি কল্পিত সম্প্রদায়, যেখানে প্রত্যেক সদস্য একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও, সার্বিক কল্যাণের জন্য একটি ঐক্যবোধ অনুভব করেন। এই ধারণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাঙ্খিত রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানসহ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন এই কল্পিত সম্প্রদায়ের প্রতীক। এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের বাংলাদেশি পরিচয়ের মূল ভিত্তি গড়ে তুলেছে। তবে এই ঐক্যের ধারণা কেবল ইতিহাসের স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। এটিকে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনায় সঞ্চারিত করতে জনশিক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। অপরদিকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা এমন হতে হবে, যা বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিটি স্তরের মানুষকে তাদের পরিচয়ের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও একীভূত হতে শেখায়। এই প্রক্রিয়ায়, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়, বরং একটি সামাজিক চুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে সবাই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এবং উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করবে। এ চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে সবার জান, মাল ও সম্পত্তির নিরাপত্তার পাশাপাশি সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হবে। ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, বৈষম্যমুক্ত ও স্বৈরাচারহীন রাষ্ট্রের আত্মাহুতি এবং রাষ্ট্রসংস্কারের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, বাংলাদেশি পরিচয়ের এই ধারণা শুধু একটি কল্পনা নয়, বরং বাস্তবতার মূর্ত প্রতীক। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ ধারণাকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে আরো সুসংহত করার উপর। আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়ে বহুত্ববাদকে স্বীকার করেই বাংলাদেশি জাতিসত্তার অঙ্গীকারের মাধ্যমে বিশ্বসভায় একটি উদীয়মান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে। একটি জাতির বিকাশের শক্তি তার নাগরিকদের আত্মপরিচয়ের বহুমাত্রিকতাকে কীভাবে সংহত করতে পারে, তার উপরই নির্ভর করে। আমাদের বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া দরকার যে, বাংলাদেশের মতো বৈচিত্র্যময় সমাজে ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম বা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য যেন কখনো বিভেদ সৃষ্টি না করে, বরং তা জাতিগত ঐক্যের উপাদান হয়ে ওঠে। এজন্য আত্মপরিচয়ের বহুত্ববাদকে কেবল মেনে নেয়া নয়, বরং শিক্ষার মাধ্যমে এটিকে একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, আমাদের জাতিসত্তা বৈচিত্র্যের মাঝেই বেড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থেকে সিলেটের সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি, কিংবা পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য- প্রত্যেকটি উপাদান আমাদের পরিচয়কে আরো সমৃদ্ধ করেছে। তাই বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করাই আমাদের ভবিষ্যতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন একটি বিকেন্দ্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা, যা আমাদের বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে বাংলাদেশি জাতিসত্তার ভিত্তিতে একত্রিত করবে। এই শিক্ষাব্যবস্থা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং এর মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এমন মূল্যবোধে গড়ে তোলা হবে, যেখানে তারা বুঝতে পারবে যে, বৈচিত্র্য কোনো বিভাজন নয়, বরং এটি আমাদের শক্তি ও সমৃদ্ধির উৎস।
‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটি একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি হলেও, এটি বাস্তবে রূপ দিতে হলে শিক্ষাকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার পাশাপাশি জাতীয় এবং বৈশ্বিক চেতনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শেখাবে। এভাবেই আমরা বহুত্ববাদের ভিত্তিতে আমাদের ভবিষ্যৎকে একটি ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। তার জন্য ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের দেখায়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচয়ের বৈচিত্র্য কোনোভাবেই জাতীয় ঐক্যের অন্তরায় নয়; বরং তা জাতীয় শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ঐতিহাসিক সত্য হলো এদেশের সাধারণ মানুষ সবসময়ই ধর্ম, পেশা, আঞ্চলিকতা কিংবা সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা উপেক্ষা করে একসঙ্গে লড়াই করেছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল জাতির মুক্তি, যা তাদের সমস্ত বৈচিত্র্যকে ছাপিয়ে একটি অভিন্ন চেতনায় একত্রিত করেছিল।
ইতিহাস প্রমাণ করে যে, যখন জাতীয় স্বার্থ বা বৃহত্তর কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, তখন ব্যক্তিগত বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় কোনোভাবেই ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং বৈচিত্র্য আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনাগুলোকে আরো সমৃদ্ধ ও অর্থবহ করে তুলেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাঙালির ভাষাতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার রাজনৈতিক সংগ্রামই ছিল না, বরং এ যুদ্ধ আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদও সামনে নিয়ে আসে। এতে বোঝা যায়, একতা আর বৈচিত্র্য একসঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে চর্চা ও লালন করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষা কেবল অতীতের জন্য নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক। আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা তরুণ প্রজন্মকে দেখাতে পারে যে, একক পরিচয়ের সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়েও কীভাবে বহুমাত্রিকতা একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধ করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন, ইতিহাসের এই পাঠকে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আরও গভীরভাবে চর্চা করা এবং মানুষের মানসের গভীরে প্রোথিত করা। শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বোঝাতে হবে যে, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ একটি তত্ত্ব নয়, বরং এটি আমাদের ইতিহাসের বাস্তবতা। ঐতিহাসিকভাবে এ ভুখণ্ডে নানা জাতির রক্তের সংমিশ্রণ যেমন ঘটেছে, তেমনি এর ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় ভেদে সম্প্রীতির চর্চা আমাদের জাতীয় শক্তির মূলে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে এটি আমাদের বাংলাদেশি জাতিসত্তার অঙ্গীকারকে আরো গভীরভাবে লালন করতে সহায়তা করবে। তাই স্বভাবতই বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এটি আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন। তবে এই বৈচিত্র্যের মাঝেও আমাদের রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার পরিচয়- ‘আমরা সবাই বাংলাদেশি’ একটি সর্বজনীন ভিত্তি, যা আমাদের সবাইকে একত্রিত করে। এই জাতীয়তা কেবল একটি রাজনৈতিক ধারণা নয়; এটি আমাদের অব্যাহত ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ফসল। রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে জাতি হিসেবে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় হবে বাংলাদেশি যা আমাদের আত্মপরিচয়ের ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ গড়ে তুলবে, আর যা হবে আমাদের শক্তি ও সমৃদ্ধির উৎস।