বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত একটি সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাধারণত সমাজে পুরুষ নির্যাতন শব্দটি তেমনভাবে উচ্চারিত না হলেও, বাস্তবতা হলো পুরুষরাও নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতন শুধু নারী কিংবা শিশুর প্রতি সীমাবদ্ধ নয়; পুরুষও বিভিন্ন প্রকার শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নির্যাতনের শিকার হন। তবে এই সমস্যা সমাজে সচরাচর সামনে আসে না, কেননা এটি মূলত পুরুষদের জন্য একটি লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে দেখা হয়, যার ফলে তারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পান না।
পুরুষ নির্যাতন : সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ : পুরুষ নির্যাতন বলতে শারীরিক, মানসিক, যৌন বা অর্থনৈতিক নির্যাতনকে বোঝায়, যা পুরুষদের প্রতি অন্য কোনো ব্যক্তির (স্বামী, স্ত্রী, পরিবারের সদস্য, সমাজের সদস্য) দ্বারা করা হয়ে থাকে। শারীরিক নির্যাতনে পুরুষদের ওপর মারধর, শারীরিক আঘাত, নির্যাতন করা হয়। মানসিক নির্যাতনে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি, আক্রমণাত্মক বা অপমানজনক আচরণ করা হয়, যা তাদের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেয়। যৌন নির্যাতন হয় বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেখানে পুরুষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বা অসম্মানজনক যৌন আচরণ করা হয়। অর্থনৈতিক নির্যাতনেও পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, যেমন তাদের উপার্জন নিয়ে অন্যরা অনৈতিকভাবে কাজ করতে পারে বা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করা হয়।
পুরুষ নির্যাতনের কারণ : পুরুষ নির্যাতনের পেছনে বেশ কিছু সামাজিক, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পুরুষদের ওপর নির্যাতন বা সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে একে একটি লজ্জাজনক বা দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে দেখার সামাজিক মনোভাব কাজ করে। বাংলাদেশের মতো দেশে পুরুষকে সবার সামনে শক্তিশালী, নির্ভীক এবং নেতৃত্বদানকারী হিসেবে দেখা হয়। এ কারণে যখন পুরুষরা শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতিত হন, তখন তারা সচরাচর বিষয়টি প্রকাশ করতে অস্বস্তি বোধ করেন। দ্বিতীয়ত, পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তন ও আর্থিক চাপও পুরুষ নির্যাতনের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন একটি পরিবারে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়, তখন তা পুরুষের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং কখনো কখনো এটি শারীরিক সহিংসতার দিকে এগিয়ে যায়। সমাজে ‘পুরুষ হলে সব কিছু সহ্য করতে হয়’ এই ধারণাও নির্যাতনের হার বাড়াতে সাহায্য করে।
আইনগত ব্যবস্থা ও প্রতিকার : বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য কিছু আইনগত ব্যবস্থা রয়েছে, তবে এটি নারীর নির্যাতনের মতো পুরুষ নির্যাতন বিষয়ক স্পষ্ট আইন এখনো তৈরি হয়নি। ২০১০ সালে পুরুষদের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং হেনস্তা মোকাবিলার জন্য ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সংশোধিত হলেও, পুরুষ নির্যাতন সংক্রান্ত বিষয়গুলো এর মধ্যে পর্যাপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে ২০০০ সালে ‘দ্যা ওয়েলফেয়ার অফ ভিকটিমস অব ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ এর মাধ্যমে সংসদ একটি আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা পুরুষদেরও সহিংসতার শিকার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া, ‘পরিবার আইন’ বা ‘প্রতিরোধ ও সহায়তা আইন’ পুরুষদের জন্য নির্যাতনের বিরুদ্ধেও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যদিও এর প্রয়োগ যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিকার : পুরুষ নির্যাতনের প্রতিকার শুধুমাত্র আইনগত ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, বরং সমাজের একটি বড় অংশের মনোভাব পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। পুরুষদেরও মানবাধিকার রয়েছে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা সমাজের দায়িত্ব। পরিবার, বিদ্যালয়, এবং সম্প্রদায়ের সর্বত্র পুরুষ নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পুরুষদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে, কাউন্সেলিং সেশন আয়োজন করতে এবং তাদের মধ্যে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস সৃষ্টি করতে হবে। তবে, এটি বলতেই হবে যে, পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা নীরব বা নেতিবাচক হয়ে থাকে, বিশেষত নির্যাতিত পুরুষরা স্বীকার করতে চায় না যে তারা নির্যাতিত। তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় যে, ‘পুরুষ হলে কষ্ট সহ্য করা উচিত’, ‘পুরুষরা কেন নির্যাতিত হবে?’ এসব নেতিবাচক মনোভাব সমাজে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। পরিশেষে বলতে চাই, পুরুষ নির্যাতন বাংলাদেশের মতো দেশে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা, যা গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এর জন্য আইনগত ব্যবস্থা, সামাজিক সচেতনতা এবং শিক্ষামূলক প্রচারণার মাধ্যমে পুরুষদের সহায়তা এবং সমাজে তাদের অধিকারের প্রতিকার নিশ্চিত করা জরুরি। পুরুষদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য উপযুক্ত সহায়তা প্রদান সমাজের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বের বহিঃপ্রকাশ।
লেখক, সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।