ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আধুনিকতার কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য সাধনা

ফজিলা ফয়েজ
আধুনিকতার কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য সাধনা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি, নাট্যকার এবং লেখক। যিনি বাংলার সাহিত্য ও কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮২৪ সালে যশোরে জন্মগ্রহণকারী দত্ত ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান যার লেখা আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে চলছে। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথম স্ত্রী জাহ্নবি দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল সেই সুবাদে মধূসুদনের যখন তেরো বছর বয়স সেই সময় থেকেই তাকে কলকাতায় থাকতে হতো।

মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক, ‘শর্মিষ্ঠা’ হলো প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতিশোধের একটি শক্তিশালী রচনা যা আজও বাংলা থিয়েটারে সঞ্চালিত এবং উদযাপিত হয়। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। পদ্মাবতী ‘কৃষ্ণকুমারী’ এই নাটকগুলো তার ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক বিষয় নিয়ে লেখা।

কবিতা, নাটক, মহাকাব্য এই তিনটি ক্ষেত্রেই মানুষকে সত্যিকার মূল্যবোধ ও বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যেমন ‘কৃষ্ণ কুমারী’ নাটকে জীবনের নিগূঢ় চিত্র ফুটে উঠেছে। বিসংবাদ ও সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের বিপন্ন জীবনের ছবি দেখা যায়। এক অনিবার্য অসহায়তা মানুষকে করেছে বিহ্বল, করুণ পরিণতির মুখোমুখি। এ ঘটনা সর্বকালের মানুষের জন্য একটি অনিবার্য সত্য বহন করে। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন, যথা: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হলো দ্য ক্যাপটিভ লেডি, হেকটর বধ ইত্যাদি।

মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে- অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্যটি। চরিত্র-চিত্র হিসেবে রয়েছেন: রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমুখ। তিনি তার কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশও করেছেন। কিন্তু সর্গান্তে তিনি নতুন ছন্দ ব্যবহার করেননি, সর্গশেষে পরবর্তী সর্গকথা আভাসিত করেননি। যদিও তিনি বলেছিলেন, ‘গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত’ তবুও কাব্যে করুণ রসেরই জয় হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ-আহৃত কাহিনীর পুণরাবৃত্তি নয়- এটি নবজাগ্রত বাঙালির দৃষ্টি নিয়তি-লাঞ্ছিত নব মানবতাবোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি-কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য এ দিক দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে একক সৃষ্টি।

মধুসূদন দত্ত তার সাহিত্য জীবনে বিশেষ করে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের সাহিত্য কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবন অনুসরণ করেন। মহান সৃষ্টি মেঘনাদ বধ মহাকাব্যটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নিজেকে স্বতন্ত্রভাব প্রকাশ করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি কাব্যে প্রথম হোমেরিক স্টাইলের লেখার প্রবর্তন করেন। তিনি এক সময় নিজেকে বলেছিলেন- ‘আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাইনি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বহু ভাষাবিদ। মাতৃভাষা ছাড়া তিনি আরো বারোটি ভাষা জানতেন। শিশুকালে গ্রামের টোল থেকে ফারসি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে তার ভাষা শিক্ষার শুরু হয়। তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলেগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারতেন। তিনি এমনকি ফারসি ও ইতালীয় ভাষায় কবিতাও লিখতে পারতেন। মধুসূদন দত্তকে বাংলায় ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দের প্রবর্তনের কৃতিত্ব দেয়া হয়। তার রচনা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রামায়ণের উপর ভিত্তি করে একটি মহাকাব্য, বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি। এই মহাকাব্য সাহিত্যিক রূপকে উন্নীত করেছে এবং স্বামী বিবেকানন্দ মেঘনাদবধ কাব্যটিকে ‘বাংলা ভাষার মুকুটমণি’ হিসাবে মন্তব্য করেছিলেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত পশ্চিমা সাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি এবং গ্রিক ক্লাসিক ভাষা চর্চায় গভীরভাবে মনোযোগী ছিলেন। যা তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের জন্য বিপ্লবী ছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্যে তার শিক্ষা তাকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য শৈলীর একটি অনন্য সংমিশ্রণ তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

সনেট প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তার অগ্রণী প্রচেষ্টার জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত সর্বাধিক পরিচিত। কবিতার প্রতি তার উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্যিক অভিব্যক্তির একটি নতুন যুগের জন্ম দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে সনেটকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের। তার সনেটের সংগ্রহ, ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ এই পশ্চিমা রূপটি বাংলা ভাষা এবং থিমের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা অর্জন করেন। তার লেখা চতুর্দশপদী কবিতাগুলো হলো, বঙ্গভাষা, কমলে কামিনী, উপক্রম, যশের মন্দির ইত্যাদি।

কবিতায় তার অবদানের বাইরে, সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যে তিনি প্রথম লেখকদের মধ্যে ছিলেন যিনি তার রচনায় প্রেম এবং মুক্তির বিষয়বস্তু অন্বেষণ করেছিলেন। তার নিজের অশান্ত জীবনের অভিজ্ঞতা রোমান্টিকতার মিশ্রণ তাকে তার সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করে । আর্থিক সংকটসহ তার ব্যক্তিগত সংগ্রাম তাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত করেন।

বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের অবদান ছিল যুগান্তকারী। নতুন থিম এবং শৈলী প্রবর্তনের মাধ্যমে, তিনি বাংলা সাহিত্যের দিগন্তকে প্রসারিত করেছেন। একজন সমাজ সংস্করক লেখক হিসাবে তার লেখাগুলো জাতিগত বৈষম্য ও ঔপনিবেশিক নিপীড়নের দিকগুলো স্পর্শ করে। বাংলা সাহিত্যে ও কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের উল্লেখযোগ্য অবদান নাট্য রচনায় অগ্রণী প্রচেষ্টা এবং সমাজ সংস্কারের পক্ষে সাহিত্যিক দৈত্য এবং বাংলা শিল্পকলা জগতে অনন্য করে তুলেছে। তার লেখাসামগ্রী আগামী বছর ধরে স্থায়ী থাকবে।

মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালায়। তার সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছে। ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে

(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি

বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত

দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত