জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে চরম বেহাল অবস্থায় ড. ইউনূসের রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ অরাজনৈতিক ইনটেরিম সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের রাষ্ট্র্রে প্রতিটি সেক্টরের রাজনৈতিক দলীয়করণকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারী বহাল রেখেই প্রায় শূন্য তহবিল নিয়ে অত্যন্ত কঠিনতম রাষ্ট্র পরিচালনার শুরু করেছিলেন যাত্রা। পুলিশ প্রশাসন শূন্য তাদের কমে ফেরানো, ওপার থেকে চাপিয়ে দেয়া বন্যা সামাল দেয়া, আনসারদের বিদ্রোহ সামাল দেয়া, সনাতনী ব্যনারে দেশি-বিদেশি প্রপাগান্ডায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা সামাল দেয়া, প্রতিদিন দাবি আর দাবির কাফেলা সামাল দেয়া, বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন, ধ্বংস প্রায় আর্থিক খাতকে ঢেলে সাজিয়ে ব্যাংক খাতকে রক্ষা করা সরকারের সাফল্য বলতেই হবে। পাঁচ মাসের অতি অল্প সময়ে পুরোনো কারিকুলাম সংশোধন করে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে বই সরবরাহ খুব একটা সহজ কাজ নয়। সেখানে কিছু ভুল থাকতেই পারে তার সংশোধন আবার কারো মনঃপুত হতে নাও পারে; কিন্তু আমাদের অসহিস্নু হওয়া, নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে একে অপরের উপর হামলে পড়া একেবারে অগ্রহণযোগ্য অপরাধ যা মেনে নেওয়া যায় না।
পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা না রাখা নিয়ে গত ক’দিন দুপক্ষের হাতাহাতি, মারা-মারিতে আহত হওয়া, বাদণ্ডপ্রতিবাদ সচিবালয় ঘেরাও করার চেষ্টা, প্রতিরোধে পুলিশের লাঠিচার্জ কাঁদানে গ্যাস জলকামান ব্যবহার করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করা। রাস্তায় মানুষের ভোগান্তির যেন আর শেষ নাই। ছাত্র-জনতার ঐক্যের ফসল জুলাই বিপ্লবের বিজয়ের পর আশা ছিল দেশ এবং দেশের মানুষ সব বিভেদ ভুলে হাঙ্গামা হাতাহাতি, মারামারি থেকে দূরে থাকব। ইনটেরিম সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা করে রাষ্ট্র সংস্কার করতে দিয়ে আমাদের দেশটাকে নতুনভাবে গড়তে দেখব। একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শিক্ষাঙ্গনে আবার শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা তাদের নিজ নিজ পড়াশোনায় ফিরে যাবে। প্রতিদিনই একটা না একটা ইস্যুতে জনজীবন আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অনেকদিন পর আবার আদিবাসী ইস্যুতে মিছিল পাল্টা মিছিলে রাস্তা সরগরম। সবার সমান অধিকারের বাংলাদেশে বিভিন্ন ইস্যুতে দাবি থাকবে প্রতিবাদ থাকবে তাতে দোষের কারণ নেই। কিন্তু আজ রাষ্টের অখণ্ডতার ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ ‘আদিবাসী’ ইস্যু কেন? বাংলাদেশের পাহাড়ে বসবাস করা কোন জনগোষ্ঠী জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী নয়। কারণ পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন ভাষাভাষী ধর্মালম্বী জনগোষ্ঠী ভারত এবং বার্মা থেকে আগত তারা অভিবাসী। আদিবাসী-উপজাতি সবার সমান অধিকারের বাংলাদেশের সবাই বাংলাদেশি। দাবি হওয়া উচিত সবার সমান ন্যায্য অধিকার এবং সুবিচার। ড. ইউনূস ঠিকই বলেছিলেন ‘আমাদের গণতান্ত্রিক যে আকাঙ্ক্ষা, সেখানে আমরা বিবেচিত মুসলমান হিসেবে নই, হিন্দু হিসেবে নই, বৌদ্ধ হিসেবে নই, মানুষ হিসেবে। আমাদের অধিকারগুলো নিশ্চিত হোক। ব্যতিক্রমে দাবি থাকবে সরকার তা বিবেচনা করবে।
২০০৭ ইং সালের আগ পর্যন্ত পাহাড়ী ভাইয়েরা নিজেদের উপজাতি পরিচয় দিতে গর্ব’ করতেন। ব্রিটিশ-পাকিস্তান দলিলপত্রে তো বটে ১৯৯৭ ইং সালে জনসংহতি সমিতির সাথে সরকারের সম্পাদিত চুক্তিতেও পাবত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বলা হয়েছে। আজ বাংলাদেশে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার মূল কারণ ‘আদিবাসী-জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র-২০০৭। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ভূমি অধিকার, স্বায়ত্তশাসনসহ অনেক অকল্পনীয় অবাস্তবায়ন যোগ্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে এই সব অধিকার বাস্তবায়নে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পাওয়ার অধিকার রাখা হয়েছে। যা কি না একটি অখণ্ড স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করার অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসী-জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র-২০০৭-এর ভোটাভুটিতে বিশ্বের ১৪৫টি দেশ পক্ষে থাকলেও অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশও জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ভোট দানে বিরত থাকে।
সশস্ত্র বিচ্ছিনতাবাদী কুকিচীন যখন আলাদা রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়, আমাদের উপজাতি ভাইয়েরা যখন দাবি তোলে, তাদের পাহাড়ে সমতলের মানুষ থাকতে পারবে না, সেনাবাহিনী থাকতে পারবেন না, তখনি প্রশ্ন জাগে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সুবিধা নিতেই কি ‘আদিবাসী’ না হয়েও এতোদিনের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-উপজাতি ভাইয়েরা আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে পার্বত্য অঞ্চলে মিশনারী, ইউরোপীয় কিছু দেশ এবং বাংলাদেশেরই তথাকথিত কিছু সুশীলজনের বিরুদ্ধে উচকানির অভিযোগ অনেক পুরোনো। আমাদের আবেগেরও যেন শেষ নেই। আজ আবার দেশের সেই সকল সুশীলদের উচ্চ কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। ২৪ জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচারের নির্মমতাণ্ডবর্বতায় শত শত ছাত্র-জনতা আহত নিহত হলেও যাদের অনেকেরই টিকিটি দেখা যায়নি। ছাত্র-জনতার দুঃসময় তারা ঘাপটি মেরেছিলেন। আজ কাদের ইন্ধনে কার উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে ‘আদিবাসী ইস্যুতে তাদের এই অপতৎপরতা?
যারা পাহাড়ী জনগোষ্টীর সাংস্কৃতিক কৃষ্টি কালচার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি দাবি করছেন, একবার ভাবুন ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আদি ঢাকাবাসীর সাংস্কৃতিক কৃষ্টি কালচার ঐতিহ্য আছে কি টিকে? এমনিভাবে চট্টগ্রাম, সিলেটবাসীর কৃষ্টি কালচার ঐতিহ্য কি পারছেন, তারা ধরে রাখতে? বাংলাদেশের বাঙালি ঐতিহ্য কি পেরেছি বাঁচিয়ে রাখতে? পাহাড়ে সাংস্কৃতিক কৃষ্টি কালচার পরিবর্তন সমতলের মানুষের কারণে যতটুকু হয়েছে, তার চাইতে শত গুণ পশ্চিমা মিশনারিদের মাধ্যমে হয়েছে। নিজেদের সাংস্কৃতিক কৃষ্টি কালচার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন তাকে ধারন করা, উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন লালন-পালন করা। অতি সহজ আকাশ সাংস্কৃতি এবং তথ্যপ্রবাহের যুগে শ্রোতের অনুকূলে ভাসিয়ে দিলে তা থাকবে কীভাবে? আমাদের দেশের ঘরে ঘরে যে কোনো অনুষ্ঠানে বম্বের সাংস্কৃতিক একছত্র আধিপত্য চলছে ছেলে-মেয়েদের কম বেশি হিন্দি ভাষা জানা আছে। এসব কি ভারত আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে? দেয়নি, আমরা তা নিজেরাই গ্রহণ করেছি। আমাদের মনে রাখতে হবে চারিদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রয়োজন বিগত ১৫ বছরের আমাদের অনেকের অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করা। একটা গ্রাফিতি পরিবর্তনের ইস্যু নিয়ে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি জন্য নানা রকম বিবৃতিতে ইনটেরিম সরকারের সমালোচনা দেশকে মৌলবাদী বলার আগে আমাদের সকলকে ‘আদিবাসী-জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র-২০০৭’ ভালো করে দেখা এবং বোঝা অনেক বেশি দরকার।
বিচ্ছিন্নতাবাদী কুকিচীনসহ অসংখ্য অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অধ্যুষিত পাহাড়ে আমরা কি চেয়েছি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী না রেখে সার্বভৌমকে হুমকির মুখে ফেলতে? সমতলের কেউ পাহাড়ে থাকতে না, পারলে সমান অধিকার থাকল কোথায়? ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আদায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর আগে বেশি করে ভাবতে হবে আমাদের কর্মকাণ্ড দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ করবে কি না?
ভারত শুরু থেকেই ২৪ জুলাই বিপ্লবকে মানতে পারেনি এখনও ড. ইউনূসের ইনটেরিম সরকারকেও মানতে পারছে না। ভারতের আগ্রাসী তৎপরতায় সীমান্ত পিলার থেকে ১৫০ গজের নোম্যান্স ল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ভারতীয় নাগরিকরা বিএসএফের সহযোগিতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গাছ এবং ফসল কাটা নিয়ে উত্তেজনা। অন্যদিকে বাংলাদেশ-ইয়াঙ্গুন সীমান্তে নতুন রাষ্ট্র তৈরির সম্ভবনায় সেখানেও উত্তেজনা। ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যবর্তন আজ অনিশ্চিত।
প্রয়োজন যখন জাতীয় এক্য সেখানে নির্বচন এবং ‘আদিবাসী’ ইস্যুতে জাতির মাঝে দেখা দিয়েছে অনৈক্য। রাষ্ট্রের অখণ্ডতার ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ ‘আদিবাসী’ ইস্যুতে এখন কোনো প্রকার রাখণ্ডঢাক না করে সরকারের স্পষ্ট বয়ান অতি আবশ্যক। ইনটেরিম সরকারের কাছে এ সমস্যার সামাধান আশা করা যাবে না। কিন্তু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমান অধিকারের বাংলাদেশে আমরা সবাই বাংলাদেশি কীভাবে শান্তিতে সম্প্রীতিতে পাশাপাশি বসবাস করতে পারি তার একটা রূপরেখা প্রস্তাব আকারে নির্বাচিত সরকারের বিবেচনার জন্য রাখা যেতে পারে। তা না হলে কিছুদিন পরপরই এই ইস্যুতে রাস্তায় মিছিল হবে হাঙ্গামা হবে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে, শান্তি-সম্প্রীতি নষ্ট হবে দিনে দিনে একে অপরের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হবে, দেশের অগ্রগতি থমকে যাবে, জনজীবনে ভোগান্তি হবে, যা কোনোভাবে বর্তমান সংকটকালীন বাংলাদেশে কাম্য হতে পারে না।