বড়রা ব্যক্তিপূজা পছন্দ করে। যারা ছোট তারা বড়দের দেখে শেখে। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, অভিজ্ঞ শিক্ষক, পাকা ব্যবসায়ী কিংবা জানু যোদ্ধা যা করে, যা বলে কিংবা যা দেখায় সেসবের সবই সঠিক বলে তাদের অনুসারীরা মনে করে। পক্ষ দলের কোনো নেতার কোনো কথার সমালোচনা হলে বিপক্ষ দলের উপর আগ্রাসী হয়ে তেড়ে যাওয়া জাতীয় ন্যাচারে পরিণত হয়েছে। কখনো কখনো বাক্য যুদ্ধে সুবিধা করতে না পারলে মল্লযুদ্ধ শুরু হয়। আমার প্রিয় শিক্ষককে সবার প্রিয় শিক্ষক হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাই। যে ব্যবসায়ীর কাছে সিন্ডিকেট সুবিধা পায় তাকে ছাড়া বাজারের সবাইকে উচ্ছেদ করার চক্রান্ত চলে।
ভিন্নমতের কেউ সঠিক কথা বললে সেটা মানার মানসিকতা দেখানো লোকের বড় অভাব। আমাদের পরমতসহিষ্ণুতা তলানিতে ঠেকেছে। উগ্রতা এবং আগ্রাসন চরমভাবে বেড়েছে। ধর্মান্ধতা এবং মতবাদ অন্ধত্ব স্বাধীন বিচার-বিবেচনাবোধকে পিষে ধরেছে। রাষ্ট্র নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে আমার দল যা বলে, যা করে কিংবা যা ভাবে তাই দেশপ্রেম! বাকিরা দেশদ্রোহী! বিরুদ্ধমত সঠিক পথ দেখালেও, সত্য কথা বললেও কিংবা ন্যায্যতা চাইলেও সেটা মানতে ও দিতে আরেকপক্ষ চরমভাবে নারাজ। দেশের পক্ষে থাক কিংবা বিপক্ষে যাক- রাজনীতির ময়দানে ভিন্ন পক্ষ যেটা করেছে সেটার বিরোধিতা করতেই হবে। রাজনৈতিক বাস্তবতার হালাল-হারাম নিজ পক্ষের স্বার্থকে ঘিরে নিরূপিত হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, নেতার সিদ্ধান্ত বেঠিক হলেও সেটাতে বাহবা দেয়ার জন্য কর্মীর অভাব নেই। দলান্ধ জনতার ধারণা পৃথিবীর সব সত্য, সব সুন্দর তাদের পক্ষ দলে অবস্থান করে। তাদের নেতা যা করে সব জায়েজ। খুন করলেও জায়েজ, লুটপাট করলেও জায়েজ। চিন্তার এমন দৈন্য চিত্র শুধু রাজনীতিতে নয় বরং সংসার-সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সমানভাবে ক্রিয়াশীল। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন কোরাম থাকে। কোরামের যিনি গোত্রপতি তিনি যা বলুক, যা করুক তা বৈধ প্রমাণের জন্য সাগরেদগণ বিপক্ষ মতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন! কোথাও কোথাও তো কুকুরের মতো কামড়াকামড়ি হয়। প্রয়োজনে হাত তোলেন, লাথি মারেন। তাতে মসজিদে আছেন, নাকি মন্দিরে গেছেন কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছেন- সেসব একবারও ভাববার প্রয়োজন মনে করেন না। নিজের অপবিত্র মনের ইচ্ছাকে পবিত্র প্রতিষ্ঠানে বসেও জায়েজ করে ফেলেন। এদেশে মসজিদণ্ডমন্দিরের টাকাও লুটপাট হয়। মাদ্রাসা-বিশ্বাবিদ্যালয়ের জমিও দখল হয়! প্রতিষ্ঠানের অগ্রজ যে গ্যাং কালচার লালন করেন তা নিরীহদের ঠকাতে! কারো অধিকার আটকাতে এবং নিজের ভাগ বড় করতে। অথচ মানুষ যদি মানুষ হতো তবে বিশেষ কোনো ব্যক্তিবাদের পুজো করার প্রয়োজন হতো না। আমাদের সুন্দর অতীত ছিল। সেবা করার নামে শোষণ করার তোষণরীতি যদি পয়দা করা না হতো তবে জাতি হিসেবে আমরাও মননে-মগজে উন্নত হতে পারতাম!
অন্ধভাবে ব্যক্তিপূজা সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে। ইতিহাসে কতশত সাম্রাজ্যের পতন কেবল ব্যক্তিবাদের অন্ধ অনুকরণের জন্য ঘটেছে, সে-সবের ইয়ত্তা নাই। প্রশংসা উপভোগ্য। সত্য প্রশংসা প্রাপ্যও। কিন্তু প্রশংসা যখন চাটুকারিতায় পরিবর্তিত হয় তখন তা শাসককে, মালিককে অন্ধ বানায়। কেউ যখন সমালোচনার পথ বন্ধ করে রাখে তখন তাকে ঘিরে রাখা স্তাবকদের দ্বারা বিপথগামী হওয়ার শঙ্কা প্রবল হয়। যারা চাটুকারিতা করে তাদের হীন-ক্ষুদ্র স্বার্থ থাকে। কিন্তু যখন এটা দ্বারা রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি আবর্তিত হয় তখন সে জাতির সর্বনাশের ঘণ্টা টুং টাং করতে শুরু করে। নিজের দলের নেতা ভুল করতে পারে, ভুল বলতে পারে। কর্মীদের চিন্তা ও বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। নেতা যদি নিজ দলের সহযোদ্ধাদের দ্বারা শুধরে যায় তবে সেটা সম্মানের। বিরোধী পক্ষ যখন সমালোচনার খড়গ পায় তখন তাতে তীব্রভাবে সম্মানহানির শঙ্কা থাকে। প্রভাবশালী নেতা যদি কারো কান কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে তবে তার পতন অনিবার্য হয়। বাংলাদেশের অতীতের শাসনব্যবস্থা, ব্যক্তি ও বংশের পতিত হওয়া কিংবা সমূহ সম্ভাবনার মুকুলেই বিনাশ হওয়ার গল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করলে অতিরঞ্জিত ব্যক্তিবাদ ও অন্ধভাবে একক ব্যক্তিকে পূজাকেন্দ্রিক ইতিহাসের কালো অধ্যায় উন্মোচিত হবে।
বয়স নিঃসন্দেহে ভিলেন। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে সিংহভাগ পেশা থেকে অবসরের নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। যেসব পেশা কিংবা সেবায় অবসরের বয়স নির্ধারণ করা যায়নি সে খাতগুলো যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততখানি বিপত্তিও দেখা যায়। দায়িত্ববানের দুয়েকটি অসংলগ্ন কথায়, আচরণ কিংবা পদক্ষেপে সাজানো বাগান এলোমেলো হয়ে যায়। কথা ছুটে চলা তীরের মতো। একবার ধনুক থেকে অগ্রসর হলে টার্গেট লক্ষ্যভেদ করা কিংবা লক্ষ্যচ্যুত হওয়া ব্যতীত সেটাকে আর খাপে ফেরানো যায় না। কেউ যখন অন্যায্য, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কিংবা কওমের জন্য ক্ষতিকারক কথা বলে এবং স্বপক্ষে সাপোর্ট পায় তখন সে জনমানুষ থেকে দানবে পরিণত হওয়ার সাহস পায়। বিপথগামী কর্তা ক্ষুদ্র পরিসরে সেবা দিলে তার অধীনরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর যদি তিনি রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হন তবে গোটা জাতিকেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পতিত করে। সুতরাং যার দায়িত্ব যত বড় তাকে কথা ও আচরণে তত সাবধান হতে হবে। কারো হাজার কথাও কোনো ক্ষতির কারণ নয় কিন্তু কারো কারো একটি-দুটি কথা ভবিষ্যতের সর্বনাশ ডেকে আনতে আনে। পদ-পদবি ভেবে, সময়-পরিস্থিতি মেপে কথা বললে সমাজ-সংসার উপকৃত হয়।
যিনি ক্ষমতায় তিনি দায়িত্বের প্রতি মমতা করে তার পাশে ঘিরে থাকা চাটুকার-দালালদের দূরে নিক্ষেপ করলে সেবা ও দায়িত্বের বিচরণ ক্ষেত্র উপকৃত হয়। যারা মিথ্যা প্রশংসা করে তাদের কায়দা করে ফায়দা হাসিলের বদ উদ্দেশ্য থাকে। কারো সম্পর্কে কেউ সঠিক সমালোচনা করলে এবং সমালোচিত ব্যক্তি যদি সেটা উপকারী ভেবে গ্রহণ করে নিজের ভুল শোধরাতে পারে তবে জাতি উপকৃত হবে। শিক্ষকেরও হাজার দোষ থাকতে পারে। বাবাও ভুল করে না? ব্যবসায়ীরাও ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। তবে যদি কেউ ভুল ধরিয়ে দেয়, তবে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে বন্ধুত্ব পাতানো উচিত।
নিন্দুককেই সবেচয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে। অগ্রজরা যা করবেন অনুজরা তা অনুকরণ-অনুসরণ করবে। দল কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের কারণে জাতীয় স্বার্থ বিনষ্ট হলে সেটার ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে। সসীম জীবের কারো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। দায়িত্বশীলরা তাদের দায়িত্ব না বুঝলে ভুলের মেরামতে নতুন ভুলের সৃষ্টি হবে। মনে রাখতে হবে, ভুল যদি বাড়তে থাকে তবে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের খেসারতের ক্ষত আরো বৃহত্তর হবে।