ফিলিস্তিনীরা দীর্ঘদিন পর নিজ জন্মভূমিতে ফিরতে শুরু করেছে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ গাড়িতে বা অন্য যেকোনোভাবে ফিরছে। বাড়ি ফেরার আনন্দ তাদের চোখণ্ডমুখ শরীরে। কিন্তু এই আনন্দ কতদিন স্থায়ী হবে সেই প্রশ্নও ঘুরছে। হয়তো অবিশ্বাসও মনের ভেতর দানা বেঁধে আছে। যদিও তাঁদের বাড়ি নেই, আসবাব নেই, কাজ নেই শুধু মাটি আছে। সেই মাটিই ভরসা। যুদ্ধ থেমেছে, যুদ্ধ থামেনি। যুদ্ধ বিরতিতে ইসরাইল-হামাসসম্মত হয়েছে। এই বিরতি কতদিন চলবে? এই বিরতিকে একটি স্থায়ী বিরতি বা বন্ধে রুপ দেয়া প্রয়োজন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধ বন্ধ করার। আপাতত একটা যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর মধ্যেই ফিলিস্তিনের জন্য একটি স্থায়ী সমাধানের পথ তিনি বের করেছেন। তবে সেই পথ নিয়ে রয়েছে সংশয় এবং সমালোচনা। এদিকে বিশ্ব চাইছে দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার ইতি টানতে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে আক্রমণের পর থেকে এই সংঘাতের শুরু হয়েছিল। হামাসের ওই হামলায় প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর প্রতিশোধ নিতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরাইল। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরাইলের সামরিক অভিযান চলাকালে ৪৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা ৪৬ হাজার ৭৮৮ জনের মৃত্যুর হিসাব পেয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ সংঘাতের এক বছরে শনাক্ত হওয়া মৃতদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। ফিলিস্তিনের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থন বাড়লেও কার্যত ইসরাইলকে এখনো দমানো যায় নি। প্রতি ঘণ্টায় সেখানে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
ইসরাইলের ফিলিস্তিনে হামলার শত দিন পার হয়েছে। এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের নিহত সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এই সমস্যার সমাধান কী হতে পারে? এখন প্রথমে গাজাকে পুনর্গঠন করতে হবে। সে একদিকে যেমন প্রচুর খরচের ব্যাপার এবং অন্যদিকে প্রয়োজন সময়। ঠিক এই সময়ের মধ্যে গাজার জনগণ কোথায় থাকবে, কী খাবে এবং কীভাবে জীবনযাপন করবে সেই প্রশ্নও রয়েছে। তাছাড়া টেকসই সমাধান ছাড়া কোনোদিনই এই অঞ্চলে শান্তি আসবে না। মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত থাকবে এবং এই ইস্যুটি বিশ্ব ইস্যু হয়ে সামনে আসবে। প্রথমেই আসা যাক এক্ষেত্রে ট্রাম্প থিওরি নিয়ে অর্থাৎ ট্রাম্প গাজা নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন সে বিষয়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাব আকারে বলেছেন গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে জর্ডান এবং মিসরে স্থানান্তর করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। ১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত গাজার জন্য এই পরিকল্পনা স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোতেও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
ট্রাম্পের প্রস্তাব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৯৪৮ সালের নাকবার স্মৃতি আবার উসকে দিয়েছে। তখন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। অনেকে জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। গাজার বহু ফিলিস্তিনি মনে করেন, তারা যদি এই অঞ্চল ছাড়েন তবে তা ১৯৪৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। ট্রাম্প বলেছেন, গাজার বাসিন্দাদের সাময়িকভাবে বা দীর্ঘমেয়াদে স্থানান্তর করা যেতে পারে। তিনি বলেন, এটি এখন আক্ষরিক অর্থে একটি ধ্বংসস্তূপ। প্রায় সবকিছুই ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ মারা যাচ্ছে। সুতরাং আমি কিছু আরব দেশের সাথে যুক্ত হতে চাই এবং একটি ভিন্ন জায়গায় আবাসন তৈরি করতে চাই, যেখানে ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে থাকতে পারবে। যদিও ফিলিস্তিনিদের মতামতটাও তো ভাবতে হবে। সেখানকার নাগরিক কী চায়? একবার জন্মভূমি থেকে সরে গিয়ে যে খেসারত তাদের টানতে হচ্ছে আবার সরে গেলে যে অন্য কোনো বিপদ চেপে বসবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? বিশ্বাস তো আগেও করেছিল। গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের জোরপূর্বক সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার শপথ নিয়েছেন ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস। হামাসও একই শপথ নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটিকে খালি করার পরিকল্পনা জানানোর পর রোববার এমন অবস্থান জানিয়েছেন তাঁরা। ১৫ মাসের এই যুদ্ধে গাজার সব বাসিন্দা উদ্বাস্তু কিন্তু তাঁরা মাটি ছাড়তে রাজি হবে না।
এই সমস্যার সমাধানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথ খুঁজছে। যদিও তাতে অগ্রগতি কমই। নতুন পরিস্থিতিতে দ্বি-রাষ্ট্র নীতি নিয়ে তেমন অগ্রগতি নেই। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রই এই প্রস্তাব দিয়েছে। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে একটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ইসরাইলের পাশাপাশি অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যেকার অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে চলা যুদ্ধে প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরীহ ফিলিস্তিনিরা এর নির্মম শিকার হচ্ছে। এই বিরতি সাময়িক নয়, পৃথিবী চায় স্থায়ী সমাধান।
স্থায়ী সমাধান না হলে কখনোই এ অঞ্চলে শান্তি ফিরবে না। যুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। যুদ্ধ পৃথিবীকে কিছ্ইু দিতে পারে না শুধু ধ্বংস ছাড়া। শুরু থেকেই ইসরাইলকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আত্মরক্ষার অধিকারের নামে যা হচ্ছে- সেটি শুধু আত্মরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন চরম অমানবতার পর্যায়ে গেছে। মানবতা ফিলিস্তিনে ভূলুন্ঠিত হচ্ছে, শিশুদের জন্য জায়গাটা এখন নরকের থেকে বেশি ভয়াবহ। গত কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব যেন যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পরাকেই নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়েছে। মানুষ এতটাই অমানবিক, প্রতিশোধ পরায়ণ এবং নিষ্ঠুর হতে পেরেছে যে ফিলিস্তিনের একটি হাসপাতালেও বোমার আঘাতে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে কিন্তু মৃত মানুষও ছিল। একজন মানুষ আর কতবার মরবে?
অতি দ্রুত এখন ইসরাইলের এই নৃশংসতা বন্ধ করা জরুরি এবং বিশ্বকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতি এবং রাজনৈতি পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করে তুলছে। ফলে যুদ্ধ বন্ধে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব আবারো সামনে এসেছে। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান মূলত ফিলিস্তিনি ও ইসরাইল নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সহজ ভাষায়, আলাদা আলাদা দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ ইহুদি জনগণের জন্য ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ফিলিস্তিন। দুটি দেশের মানুষ একে-অপরের পাশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে সেটি সমাধানের জন্য দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকেই সবচেয়ে উত্তম মনে করছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ও ইসরাইল আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অনেক দেশ এতে সমর্থন জানায়। ইসরাইল ক্ষমতা দখলের পর থেকে গাজায় একের পর এক হামলা চালায়। দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত্বটি এসেছিল ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে এবং দু’পক্ষই তাতে সম্মত হয়েছিল। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নীতির উৎস মূলত ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস চুক্তি (শান্তি চুক্তি)।
১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। দুই পক্ষই জেরুজালেম শহরকে নিজেদের রাজধানী হিসাবে দাবি করে। দুই দেশের মধ্যে একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজার উদ্দেশ্যেই একটি মডেল দাঁড় করানো হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এ তত্ত্ব বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বিভিন্ন সময় এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। দ্বি-রাষ্ট্র নীতিতে এখনো সমাধান সম্ভব এটা বিশ্বাস করে বেশিরভাগ দেশ ও মানুষ। দুটো আলাদা দেশ হবে এবং আলাদা আলাদা স্বাধীন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এভাবে সমাধান সম্ভব। তাছাড়া যুদ্ধ চলতেই থাকবে। যদি উভয় পক্ষই এ চুক্তি বা দ্বি-রাষ্ট্র নীতি মেনে চলে তাহলে অমিমাংসিত বিষয়গুলো উভয়ের সম্মতিতে মিমাংসা করা সম্ভব হবে। তবে সেটাও অনিশ্চিত।
ফিলিস্থিনিদের সাথে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বিরাষ্ট্র নীতি উল্লেখযোগ্য সমাধান হতে পারে। কিন্তু ফিলিস্তিন এত সহজে তাদের এই প্রস্তাব মানবে কি না সেটাই প্রশ্ন। ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিষয়ে বিশ্বকে একমত হতে হবে এবং তাদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। ইসরাইলের একের পর এক আক্রমণে ফিলিস্তিনের অনেক এলাকা আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কত দিনে ঐ অঞ্চলে একটি স্থায়ী সমাধান আসবে সেটাও নিশ্চিত নয়। যাদের মাথার ওপর ছাদ ছিল। আজ নেই। মানুষের তৈরি অস্ত্র সেই ছাদ ধ্বংস করে দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে আসলে গভীরভাবে ভাবতে হবে যে তারা কি চায়, যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা? এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলা যুদ্ধবিরতি অতীতেও কার্যকরের পর ফের উভয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। অতীতেও ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিরসনে বিশ্বে দাবি জোরালো হয়েছে। পরিকল্পনা হয়েছে, প্রস্তাব হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুই একটি স্বাধীন ভূমির প্রত্যাশা করে। যুদ্ধ বা হানাহানি জন্ম থেকে প্রত্যাশা করে না। ফিলিস্তিনের জন্য ট্রাম্প থিওরী বেশি কার্যকর হবে না দ্বি-রাষ্ট্র নীতি কার্যকর হবে, সে নিয়ে বিশ্ব নেতাদের ভাবতে হবে।