ঢাকা ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৮ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বইমেলার ইতিহাস ও অর্থনৈতিক দিক

মাহমুদ সালেহীন খান
বইমেলার ইতিহাস ও অর্থনৈতিক দিক

প্রতিটি বাঙালির কাছে ফেব্রুয়ারি মাস অন্যরকম অর্থ বয়ে আনে। এই মাসের ২১ তারিখে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে জীবন দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বার। ভাষাশহীদদের স্মরণে প্রতি বছর বাংলা একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা। রাজধানী শহর ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই শুধু নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও অনেকেই এই মাসে ঢাকায় আসেন অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য (লেখক, পাঠক বা প্রকাশক হিসেবে)। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের মনে ও মননে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত এই বইমেলার শুরুর ইতিহাসও চমকপ্রদ ও অনুপ্রেরণামূলক। আমরা অনেকেই জানি না যে, প্রতি বছর হাজার হাজার বইয়ের লাখ লাখ কপি বিক্রি হওয়া বইমেলা শুরু হয়েছিল মাত্র ৩২টি বই দিয়ে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে নির্মিত বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টল দেখে এখন আর কল্পনাও করা যায় না চটের ওপর বিছিয়ে শুরু হয়েছিল বইয়ের প্রদর্শনী। হ্যাঁ, অমর একুশে বইমেলার শুরু হয়েছিল বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনের বটতলায়, চটের ওপর ৩২টি বই নিয়ে। শুরু করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও মেলার একটি অংশ আয়োজন করা হয়।

বইমেলার ইতিহাস প্রায় বাংলাদেশের সমান বয়সী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন নিরপরাধ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হত্যা করা শুরু করে তখন দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই লেখকরা বই লিখে সাহিত্যচর্চা করে স্বাধীনতা যুদ্ধকে মনোবল জোগানোর জন্য প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনেই ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী লেখকরা তাদের সময়কার লেখা প্রকাশ করেন। প্রকাশক ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রথমবার ফেব্রুয়ারি মাস এলে একে অন্যরকমভাবে বরণ করার পরিকল্পনা করেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনের বটতলায় একটা চটের ওপর স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত ও তার সংগ্রহে থাকা ৩২টি বই সাজিয়ে বসেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে সেদিনই অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং অন্যরাও বাংলা একাডেমি মাঠে নিজেদের বই বিক্রিতে অংশ নেয়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হলেও অংশ নেয়া এবং মেলার জন্য জায়গা বরাদ্দ দেয়া ছাড়া বাংলা একাডেমির আর কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। পরে এই পরিসর বাড়তে থাকায় বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না-হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়। ২০২০ সাল থেকে এ মেলার নামকরণ করা হয় অমর একুশে বইমেলা।

অংশগ্রহণকারী বেড়ে যাওয়ায় প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশু কর্নার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি এলাকায় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। চেনার জন্য মেলা চত্বরকে ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নামে নামকরণ করা হয়। এই মেলায় বাংলাদেশ সরকারের বহু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, তাদের স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। মেলায় থাকে লেখক কর্নার ও তথ্যকেন্দ্র। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য মেলা প্রাঙ্গণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

মেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রতিদিনই চলে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২০১০ সাল থেকে এই মেলার প্রবর্তক চিত্তরঞ্জন সাহার নামে একটি পদক প্রবর্তন করা হয়। সেরা বইয়ের প্রকাশককে সম্মানিত করা হয় এই পুরস্কারের মাধ্যমে। পুরস্কারটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’। এছাড়া স্টল ও অঙ্গসজ্জার জন্য দেয়া হয় ‘সরদার জয়েনউদদীন স্মৃতি পুরস্কার’। সর্বাধিক গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য সেরা ক্রেতাকে দেয়া হয় ‘পলান সরকার পুরস্কার’।

মন আর মননে প্রাণের মেলা হলেও অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাণিজ্যিক দিকটা চমকে দেয়ার মতোই। দেশের অর্থনীতিতে সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ এ খাতের অবদান যে কিছুটা রয়েছে তা উপেক্ষিতই থেকে যায় অনেকের কাছে। নিন্দুকেরা বলেন, ইন্টারনেটের যুগে কাগজের বইয়ের কদর কমে গেছে। তাই বই আর কেউ পড়ে না। প্রকাশকরা কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছে এ খাতটি। তবে আশাবাদীরা বলছেন, বই বিক্রি দিন দিনই বেড়ে চলেছে। তরুণদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমে যায়নি। বিশেষ করে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো প্রাণের মেলা তরুণদের বইপ্রেমীকে উসকে দেয় প্রতিবছরই। অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাণিজ্যিক দিকটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বইমেলার অর্থনীতি নানাভাবে, বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত। পরিবহন শ্রমিক, মুটেরা দেখে বাড়তি টাকার মুখ।

অন্যদিকে এ সময়ে বিজ্ঞাপনের ব্যবসাও থাকে রমরমা। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বইমেলাকেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপা হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। এ বিজ্ঞাপন লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টরা চান, বইয়ের খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন প্রচার ও প্রকাশ দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোই পরবর্তীকালে চলে যায় পুরোনো বইয়ের দোকানে। ঢাকার পল্টন, মিরপুর, নীলক্ষেত এলাকায় পুরোনো বইয়ের ব্যবসা সরগরম থাকে সারা বছরই। তাছাড়া প্রতিবছরই বই বিক্রি বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত আয়ও। দুই বছর আগেও মেলায় টার্গেট ধরা হয়েছিল ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার মতো। আর এখন টার্গেট ধরা হচ্ছে প্রায় শত কোটি টাকা।

২০১৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরুর আগে ৩৫ কোটি টাকার বই বিক্রির টার্গেট ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ কোটি টাকা। এ কারণে পরের বছর ২০১৬ সালে ৫ কোটি টাকা যোগ করে টার্গেট ধরা হয়েছিল ৪৫ কোটি টাকা। তবে অবিশ্বাস্যভাবে মেলা শেষে দেখা যায় টার্গেটের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৮০ কোটি টাকার ওপরে বই বিক্রি হয়েছে। এরপর ২০১৭ সালের টার্গেট ধরা হয়েছিল ৬০ কোটি টাকার মতো। তবে এ ক্ষেত্রেও টার্গেট অতিক্রম করে বিক্রি হয় ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই। গত বছর ২০১৮ সালে বই বিক্রি হয় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার। এই বছরে মেলা শুরুর প্রথম ৬ দিনে শুধু বাংলা একাডেমির ২৫ লাখ ৩১ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রথম ৬ দিনের চেয়ে সাত লাখ টাকা বেশি।

সাংবাদিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত