ঢাকা ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৮ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভুলে যেতে চাই এমন বিপিএল

আজহার মাহমুদ
ভুলে যেতে চাই এমন বিপিএল

এবারের বিপিএল সত্যি বলতে ভিন্ন একটি বিপিএল হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। এমন বিপিএল কেউ আগে কখনও দেখেনি। বিসিবি যেমনটা বলেছেন, কার্যত তেমনি হয়েছে, এটা নতুন এক বিপিএল। তবে সমস্যা একটাই, এই বিপিএল বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা, খেলোয়াড়রা এবং স্বয়ং বিসিবিও ভুলে যেতে চাইবে। সমর্থকরা এবারের বিপিএল নিয়ে এতোটাই বিরক্ত যে, বিপিএলকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের বদলে বিনোদন প্রিমিয়ার লীগ, বিতর্ক প্রিমিয়িার লীগ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। এর কারণও আছে, সেসব কারণ নিয়েই এই লেখাটি।

বিতর্ক দিয়ে বিপিএল শুরু : এই বিপিএলের শুরুটা হয়েছে ভাঙচুর আর আগুন দিয়ে। এরপরেও টিকেট কালোবাজারি থেমে ছিল না। বরং ঢাকা থেকে সিলেট, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা সবখানেই এই কালোবাজারিদের প্রভাব ছিল শতভাগ। সরজমিনে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে দেখে গেছে একেকজন কালোবাজারির হাতে ২০-২৫টা টিকিট রয়েছে। তারা অনলাইনে এবং অফলাইনে নানান সিন্ডিকেট মেন্টেইন করে এসব টিকিট সংগ্রহ করে। এরপর ২০০ টাকার টিকিট ৫০০ টাকা, ৩০০ টাকার টিকিট ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি করছে। সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা বাধ্য হয়ে সে-সব টিকিট কিনছেন। যে কারণে মূলত বিপিএলের প্রথমদিন গেট ভাঙচুর হয়েছিলো এবং অন্যদিন আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ক্ষুব্ধ দর্শকরা।

বিপিএলের লজ্জা রাজশাহী : এবারের বিপিএলের সর্বপ্রথম নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে দুর্বার রাজশাহী। রাজশাহীর খেলোয়াড়দের অনুশীলন বয়কট গণমাধ্যমে আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে যায়। এর কারণটাও পরিষ্কার, বিপিএলের প্রায় অর্ধেক খেলা হয়ে গেলেও ১ টাকাও পায়নি খেলোয়াড়রা। এমনকি টিএ-ডিএ পর্যন্ত পায়নি কিছু কিছু খেলোয়াড়। খেলোয়াড়দের রাজশাহীর মালিক চেক দিলেও সেই চেক বাউন্স করে। এই দলের মালিকপক্ষের এমন কার্যক্রম পুরো বিপিএলকে করেছে কলঙ্কিত। যদিও পরে আশ্বাস আর বিশ্বাস দিয়ে কোনো মতে খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলিয়েছে রাজশাহীর মালিক। কিন্তু তখনও বাকি ছিল আসল নাটক। টানা ১০টা ম্যাচ খেলার পরেও যখন খেলোয়াড়রা টাকার মুখ দেখেনি। এমন সময় এই দলের বিদেশি ক্রিকেটাররা হলেন একজোট।

তারা সবাই মিলে রাজশাহীর ১১তম ম্যাচটা বয়কট করলেন। ঘটনা এমন পর্যায়ে গিয়েছে শেষ পর্যন্ত মালিকপক্ষ টাকা নিয়ে বিদেশি খেলোয়াড়দের দরজায় কড়া নাড়লেও সাড়া দেয়নি খেলোয়াড়রা। বিসিবিও অনেক চেষ্টা করেছে, তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আর এতেই রচিত হলো বিপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লজ্জ্বার রেকর্ড। বিপিএলের ইতিহাসে প্রথম কোনো দল ১১ জন দেশি খেলোয়াড় নিয়ে ম্যাচ খেললো। যদিও সেই ম্যাচে ঘটেছে আসরের সবচেয়ে বড় অঘটন। টেবিলের শীর্ষে থাকা রংপুরকে ১১ দেশি খেলোয়াড় নিয়ে, পাওনা টাকা না পাওয়া মানসিকভাবে বিপর্যস্ত খেলোয়াড়রা হারিয়ে দিলো।

রাজশাহী অবশ্য সবার আগে ১২টা ম্যাচ খেলে ফেরেছে। তারা ১২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের ৪ নম্বরে অবস্থান করছে। এরমধ্যে আরো একবার বাউন্স করে ক্রিকেটারদের চেক। মোটকথা একটা নাট্যমঞ্চ তৈরি করে ফেলেছেন রাজশাহীর মালিক পক্ষ। এতেই শেষ নয়, রাজশাহীর মালিক পক্ষ পরতে পরতে রেখেছে সাসপেন্স। সবার আগে ১২টা ম্যাচ শেষ করায়, প্লে-অফের সমীকরণে ঝুলছিল দলটির ভাগ্য। তাই এই দলটার হোটেলে থাকার কথা। তখন আরো একটা বিতর্ক ছড়িয়ে দিলো এই দলের মালিক পক্ষ। তারা ঘোষণা দিলো ঢাকায় বসবাসরত খেলোয়াড়দের হোটেল ছাড়তে। একটা দলের মালিক কতটা নিচে নামলে এমনটা করতে পারে! অনেকেই তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দল নিয়ে করেছে ট্রল। প্লে-অফে জায়গা করে নিলে এই মালিকের খরচ বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন নেটিজেনরা।

দলগুলোর রঙ্গ-তামাশা : এবারের বিপিএলকে শুধু রাজশাহী একাই কলঙ্কিত করেছে বিষয়টা এমন নয়। সম্মিলিতভাবে এটা করা হয়েছে। এরমধ্যে চিটাগং কিংসও অন্যতম। এই দলের বিরুদ্ধেও আছে খেলোয়াড়দের টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগ। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, টুর্নামেন্টের প্রায় শেষদিকে চলে আসলেও লংকান ক্রিকেটার বিনোরা ফার্নান্দোকেও কোনো টাকা দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে সেটি প্রকাশ হলে তড়িঘড়ি করে কিছু অর্থ তাকে দিয়ে সেই আলোচনা বন্ধ করা হয়। তবে পারভেজ হোসেন ইমনের বেলায় দলের মালিক নিজেই স্বীকার করেছেন তাকে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি।

সেটার কারণ হিসেবে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, পারভেজ তাকে ব্যাক্তিগতভাবে সেটিসফেকশন করতে পারেনি। একটা দলের মালিক যখন টুর্নামেন্টের প্রায় শেষদিকে এসে একটা খেলোয়াড়কে টাকা না দিয়ে উল্টো এমন কথা গণমাধ্যমে গলা উঁচিয়ে বলে তখন চোখ কপালে উঠে যে কারও। অথচ এই দল আবার ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর ও কানাডিয়ান হোস্ট রেখেছে। মজার বিষয় হচ্ছে সেই ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর শহীদ আফ্রিদিও না-কি টুর্নামেন্টের শেষ সময় পর্যন্ত টাকা পাননি। এ নিয়ে আফ্রিদির এজেন্ট গণমাধ্যমে করেছেন অভিযোগ। সময় মতো পারিশ্রমিক না দেয়া, কিংবা পারিশ্রমিক নিয়ে গড়িমাসির কারণটা খুব সহজ। বিপিএল শুরুর আগে বিসিবিকে গ্যারান্টি মানি দিতে হয়। এতো বছর ধরে যা ৮ কোটি টাকা করে দিতে হতো। এবছর নানান সমস্যার কারণে সেটা ৩ কোটি করেছে বিসিবি সভাপতি। অথচ সেই ৩ কোটি টাকা দিয়েছে শুধুমাত্র ফরচুন বরিশাল। বাকি একটা দলও সেই টাকা পুরোটা দেয়নি। কোনো দল তো এক টাকাও দেয়নি! অবস্থা যখন এমন, তখন খেলোয়াড়দের টাকা দিবে কীভাবে? এই দায় তো দলগুলোর একার নয়, দায় এড়াবার কোনো সুযোগ বিসিবিরও নাই। মাননীয় বিসিবি বস কি এই দায় স্বীকার করে কোনো নজির স্থাপন করবেন?

এছাড়াও এই রঙ্গ ভরা বিপিএলে রঙ্গ দেখানোর জন্য ঢাকা ক্যাপিটালস শেষ দুই ম্যাচের আগে এনেছে অস্ট্রেলিয়ান হোস্ট। অথচ এই দলটা জানে তারা টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়েছে। শেষ দুই ম্যাচের আগে তারা এই হোস্ট এনে টুর্নামেন্টে মশকরা করেছে। যেটা তারা চাইলে শুরুতেই আনতে পারতো। একই কাজ সিলেটেরও। মানসম্মত খেলোয়াড় না এনে হোস্ট রেখে তারা বিপিএলের আলোচনায় আসতে চেয়েছে। চট্টগ্রাম এই দিকে এককাঠি সরেস। তারা কানাডিয়ান হোস্টের পাশাপাশি পাকিস্তানি ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডরও নিয়ে এসেছেন। অথচ শহীদ আফ্রিদিকে ১০০ ডলার দিয়ে না কিনে সেই টাকায় ভালো কয়েকটা বিদেশি খেলোয়াড় আনা যেতো। এগুলো স্রেফ মশকরা করা দর্শকদের সাথে। আগে ঘরে চেরাগ না জ্বালিয়ে মসজিদে চেরাগ জ্বালানোর মতো কান্ড এসব।

ফিক্সিগুঞ্জন : নানান কারণে সমালোচিত বিপিএলের অন্যতম বড় কলঙ্ক হচ্ছে ফিক্সি গুঞ্জনের বিষয়টি। বিপিএলে অন্তত ৮টি ম্যাচে অস্বাভাবিক আচরণ এসেছে সন্দেহের তালিকায়। অস্বাভাবিক কিছু নো বল, ওভার দ্য স্টেপে প্রায় এক হাত বাইরে পড়েছে কোন কোন বোলারের পা। এমনকি পিচের বাইরে বল পড়েছে একাধিক। বিসিবির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট এই ব্যাপারে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অন্তত ১২ জন ক্রিকেটারকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে তারা। এরমধ্যে একাধিক ক্রিকেটারকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় তদন্তে শেষ পর্যন্ত কোনো সত্য প্রকাশ হবে কি না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত