ঢাকা রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে জাকাতের ভূমিকা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে জাকাতের ভূমিকা

মাহে রমজান ইবাদতের মৌসুম। এ মাসে ইসলামের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সম্পাদিত হয়। ফজিলত, বরকত ও রহমতে ভরপুর এ মাসে মুমিনের হৃদয়-মন ছাওয়াবের ফোয়ারায় জেগে ওঠে। রোজা ও জকাত দুটি পর্যায় ক্রমিক ফরজ। দ্বিতীয় হিজরিতে রোজা ফরজ হওয়ার পরপরই শাওয়াল মাসে জাকাত ফরজ হয়। আর মাহে রমজানে এ দুটি আনজাম দিতে হয়। এতে অতিরিক্ত সওয়াব মিলে। অবশ্য, যে কেউ যখনই তার গচ্ছিত সম্পদের বর্ষপূর্তি হবে তখনই তার জাকাত আদায় করে দিলে কোনো আপত্তি নেই। হজরত ইবনে আকীল ‘আল ওয়াজেহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘জাকাত ফরজ হয়েছে রোজা ফরজ হওয়ার পর’। আর জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এটি ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি। জাকাত আদায় করা হলে মানুষের ধন-সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় হয়। ফলে তা হালাল ও পবিত্র হয়। আবার জাকাতের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়, সমাজে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকে এবং সচ্ছল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে অর্থেই জাকাত অর্থ বৃদ্ধি করা। ইসলাম একমাত্র আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান। এটি বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তির সনদ। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, স্বাংস্কৃতিক, অর্থনেতিক, ধর্মীয় ও আর্ন্তজাতিক তথা- সার্বিক জীবনের সব সমস্যার সমাধান রয়েছে, মহান রাব্বুল আলামীনের ঐশি পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআনুল কারীমের মধ্যে। এ শাশ্বত জীবনবিধান মানব সমাজে দ্যুাতি ছড়িয়ে পথ-পদর্শন করেছে যুগ যুগান্তরে। এর পরশে আলোকিত হয়েছে বর্বর জাহিলি সমাজ। ঘন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতি পরিণত হয়েছে গোটা বিশ্বের অনুকরণীয় আদর্শে। সে কালজয়ী আদর্শ শাশ্বত জীবন বিধান ইসলাম পাঁচটি মূলভিতিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত যথা- ১. ঈমান বা বিশ্বাস ২. সালাত বা নামাজ ৩. সাওম বা রোজা ৪. হজ ও ৫. জাকাত। আজকের আলোচ্য বিষয় হলো- ইসলামের পাঁচটি মূলভিত্তির পঞ্চম ভিত্তি জাকাত।

জাকাত শব্দের অর্থ : জাকাত শব্দের অর্থ যা পরিশুদ্ধকর, এটি হলো ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভবের একটি। প্রত্যকে স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে তা গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তি হিজরি ১ বছর ধরে থাকলে মোট সম্পত্তরি ২.৫ শতাংশ (২.৫ শতাংশ) বা ১/৪০ অংশ বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের মধ্যে হজ এবং জাকাত শুধুমাত্র র্শতসাপক্ষে সম্পদশালীদের জন্য ফরজ বা আবশ্যিক হয়।

জাকাতের নিসাব ও হিসাব : ক. সোনা ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম (প্রায়)। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম (প্রায়)। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৩৯৪; আল ফিকহুল ইসলামী : ২/৬৬৯) দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। তাই মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। যার কাছে সাড়ে ৫২ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যাবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫০ শতাংশ) জাকাত দেয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)

জাকাতের শর্তসমূহ : স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কতিপয় র্শতসাপক্ষে তার উপর জাকাত ফরজ হয়ে থাকে। যেমন-

সম্পদের উপর র্পূণ মালিকানা : সম্পদের উপর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদের মালকিানা সুনর্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। র্অথাৎ সম্পদ, মালিকের অধিকারে থাকা, সম্পদের উপর অন্যের অধিকার বা মালিকানা না থাকা এবং নিজের ইচ্ছামতো সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার করার র্পূণ অধিকার থাকা। যে সকল সম্পদের মালিকানা সুস্পষ্ট নয়, সে সব সম্পদের কোনো জাকাত নেই, যেমন: সরকারি মালিকানাধীন সম্পদ। অনুরূপভাবে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়াক্ফকৃত সম্পদের উপরে জাকাত ধার্য হবে না। তবে ওয়াক্ফ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোত্রের জন্য হয়, তবে তার উপর জাকাত দিতে হবে।

সম্পদ উৎপাদনক্ষম হওয়া : জাকাতের জন্য সম্পদকে অবশ্যই উৎপাদনক্ষম, প্রবৃদ্ধিশীল হতে হবে, অর্থাৎ সম্পদ বৃদ্ধি পাবার যোগ্যতাই যথেষ্ট। যেমন- গরু, মহিষ, ব্যবসার মাল, নগদ অর্থ ব্যবসায়িক উদ্দশ্যে ক্রীত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি মালামাল বর্ধনশীল অর্থাৎ যেসব মালামাল নিজের প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়, সেসবের উপর জাকাত র্ধায হবে না, যেমন: ব্যক্তিগত ব্যবহারের মালামাল, চলাচলের বাহন ইত্যাদি।

মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকা : সারা বছররে মৌলিক প্রয়োজন মটিয়ে যে সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকবে, শুধুমাত্র তার উপরই জাকাত ফরজ হবে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে উল্লেখ রয়েছে- ‘লোকজন আপনার নিকট (মুহাম্মদের (সা.) নিকট) জানতে চায়, তারা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করবে? বলুন, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আল্লাহ এভাবেই তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বিধান বলে দেন।’

মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) (বলেছেন- ‘অতিরিক্ত বলতে পরিবারের ব্যয় বহনের পর যা অতিরিক্ত বা অবশিষ্ট থাকে তাকে বুঝায়।’ ইউসুফ আল-কারযাভীদর মতে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ও পিতা-মাতা এবং নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণও মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত।

ঋণ মুক্ততা : নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলেও ব্যক্তির ঋণমুক্ততা, জাকাত ওয়াজিব হওয়ার অন্যতম শর্ত। যদি সম্পদের মালিক এত পরিমাণ ঋণগ্রস্থ হন যা, নিসাব পরিমাণ সম্পদও মিটাতে অক্ষম বা নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার চেয়ে কম হয়, তার উপর জাকাত ফরজ হবে না। ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরমিাণ সম্পদ থাকলেই কেবল জাকাত ওয়াজিব হয়। তবে এক্ষেতে দ্বিতীয় মতটি হলো: যে ঋণ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয় সে ঋণের ক্ষেতে যে বছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হয়, সে বছর সে পরিমাণ ঋণ বাদ দিয়ে বাকিটুকুর উপর জাকাত দিতে হয়। কিন্তু ঋণ বাবদ জাকাত অব্যাহতি নেয়ার পর অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় সে সম্পদরে উপর জাকাত দিতে হবে।

সম্পদ এক বছর আয়ত্তাধীন থাকা : নিসাব পরিমাণ স্বীয় সম্পদ ১ বছর নিজ আয়ত্তাধীন থাকা জাকাত ওয়াজিব হওয়ার র্পূবর্শত। তবে কৃষিজাত ফসল, খনিজ সম্পদ ইত্যাদির জাকাত (উশর) প্রতিবার ফসল তোলার সময়ই দিতে হবে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির খেতে বছর শেষে বর্ণিত সম্পদ ও দায়-দেনা অনুসারে জাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।

বিশেষ ক্ষেত্রে জাকাত : অপ্রাপ্তবয়স্ক ও পাগলের জাকাত: সম্পদের মালিক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিংবা পাগল হলে, তার জাকাত আইনানুগ অভিভাবককে আদায় করতে হবে।

যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তির জাকাত : কোনো সম্পদে যৌথ মালিকানা থাকলে সম্পদের প্রত্যেক অংশীদার তার স্ব-স্ব অংশের উপরে জাকাত দিবেন, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় বা তার অতিরিক্ত হয়। অর্থাৎ সম্পদের স্বীয় অংশের মূল্য অন্যান্য সম্পদের সাথে যোগ করে হিসাব করে যদি দেখা যায় তা নিসাব পরিমাণ হয়েছে বা অতিক্রম করেছে, তবে জাকাত দিতে হবে।

নির্ধারিত জাকাত : জাকাত নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও যে পরিশোধের আগেই সম্পদের মালিকের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধীকারগণ অথবা তার তত্ত্বাবধায়ক তার সম্পত্তি থেকে প্রথমে জাকাত বাবদ পাওনা ও কোনো ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করবেন। এরপর অবশিষ্ট সম্পত্তি, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হবে।

তত্ত্ববধায়কের দায়িত্বে ন্যস্ত সম্পদের জাকাত : মালিকের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত আইনানুগ তত্ত্বাবধায়কের কাছে সম্পত্তি ন্যস্ত থাকলে মালিকের পক্ষে উক্ত তত্ত্বাবধায়ক সে জাকাত পরিশোধ করবেন।

বিদেশস্থ সম্পদের জাকাত : জাকাত ওয়াজিব হবার জন্য সম্পত্তি নিজ দেশে থাকা র্শত নয়। বরং সম্পত্তি অন্য দেশে থাকলেও তার উপর জাকাত দিতে হবে। তবে উক্ত দেশ ইসলামী রাষ্ট্র হলে এবং দেশের সরকার যাবতীয় সম্পদের উপর জাকাত দিলে তা আর আলাদা করে দিতে হবে না।

জাকাত বণ্টনের খাতসমূহ : পবিত্র কুরআনের সুরা আত-তাওবা জাকাত বণ্টনে আটটি খাত আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করছেনভ এই খাতগুলো সরাসরি কুরআন দ্বারা নির্দিষ্ট এবং যেহতেু তা আল্লাহর নির্দেশে, তাই এর বাইরে জাকাত বণ্টন করলে জাকাত ইসলামী শরিয়ত সম্মত হয় না

১. ফকির (যার কিছুই নেই) ২. মিসকীন (যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই) ৩. জাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী (যার অন্য জীবিকা নেই) ৪. অমুসলিমদের মন জয় করার জন্য ৫. ক্রীতদাস (মুক্তির উদ্দেশ্যে) ৬. ধনী সম্পদশালী ব্যক্তি যার সম্পদের তুলনায় ঋণ বেশি ৭. (স্বদেশ ধনী হলেও বিদেশে) আল্লাহর পথে জিহাদে রত ব্যক্তি ৮. মুসাফির (যিনি ভ্রমণকালে অভাবে পতিত)। অনেকে জাকাতের অর্থে শাড়ি ক্রয় করে তা বণ্টন করে থাকেন। এভাবে জাকাত আদায় হয়ে গেলেও আসলে প্রকৃতপক্ষে জাকাত গ্রহণকারীর তেমন উপকার হয় না। তাই জাকাত বণ্টনের উত্তম পন্থা হলো জাকাত যাদের প্রদান করা যায়, তাদের একজনকেই বা একটি পরিবারকেই জাকাতের সম্পূর্ণ অর্থ দিয়ে স্বাবলম্বী করে দেয়া ।

জাকাত গণনার নিয়ম : প্রতিজন মুসলমানকে তার যাবতীয় আয়-ব্যয়-সম্পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়। হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাৎসরিক ভিত্তি একটি মৌলিক ধারণা। অর্থাৎ বছরে একটা নির্দিষ্ট দিন থেকে পরবর্র্তী বছরে একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত যাবতীয় আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখতে হয়। এই বাছাই করার ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যে কোনো মাসে দিন নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত কেউ কেউ হিসাব সংরক্ষণের সুবিধার্থে হিজরি বছরে প্রথম মাস মহররমের কোনো দিন কিংবা অধিক পূণ্যের আশায় রমজান মাসের কোনো দিন বাছাই করে থাকেন। এই হিসাব সংরক্ষণ হতে হবে যথেষ্ট সূক্ষ্মতার সাথে। সংরক্ষিত হিসাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্মের নিমানুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলে তবেই উক্ত ব্যক্তির উপর জাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক (ফরজ) হয়, অন্যথায় জাকাত দিতে হয় না।

আল্লাহ আমাদের সমাজের জাকাত প্রদানকারী প্রত্যেককে এমনভাবে জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন যাতে এই সমাজ গরিব-দুঃখীমুক্ত সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আল্লাহ আমাদের তাওফকি দান করুন। আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত