ঢাকা রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নকশী কাঁথার মাঠ ও কবি জসিম উদদীন

আফতাব চৌধুরী
নকশী কাঁথার মাঠ ও কবি জসিম উদদীন

যথার্থ পল্লী বাংলার আশ্চর্য কবি-শিল্পী জসিম উদদীন। গ্রাম ও মাটির প্রতি নাড়ির গভীর টান ও আত্মিক বন্ধন নিবিড় হলে যে ছাপ কাব্য-কবিতায় ঝরে পড়ে তারই উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে আছে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্য কবিতায়। কবির বিপুল জীবনাদর্শ ও কাব্য-খ্যাতির সঙ্গে বৃহত্তরভাবে জড়িয়ে না থাকলেও আলোচ্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্য-কবিতাটি অনেকের মতো আমাকেও ভিন্ন ভিন্নভাবে আকর্ষিত করেছে। অবশ্য এ গৌরব কবির নিজের। ধার করা আধুনিকতাকে ধিক্কার দিয়ে জসিম উদদীন যেভাবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটে গেছেন, তার জন্য এ কাব্যটি অবশ্যই আলাদা মাত্রা পাওয়ার দাবিদার। টুকরো টুকরো চৌদ্দটি কবিতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ কাব্যটির মধ্যে প্রেমকাহিনীর পাশাপাশি আছে অদ্ভূত ধরনের নিখুঁত লোকায়ত জীবনের ছবি। হয়তো পল্লী বাংলার মানুষ এবং জনজীবন ভালোবাসতেন বলেই তার কবিতায় জীবনানন্দীয় আবহ বড় কম নয়। মনে হয় কখনও কখনও লোক জীবনের বাইরের জীবন অনেক দেখলেও মনের দিক থেকে তাকে তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই কোথাও গ্রাম বাইরের উপমা-চিত্রকল্পকে তেমন করে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু আশ্চর্য এ শিল্পী মানুষটি বাংলার পাখি-পানি-বিল-চাষির উপমা যেভাবে ও ভাষায় দিয়েছেন তাতে প্রকৃতি প্রাণ এ মানুষটিকে কোথাও চিনে নিতে আমাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। বরং গ্রামবাংলার লোকজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়ে নিজেই হয়ে উঠেছেন অন্য জগতের মানুষ-

‘বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী

উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি।’ (পৃঃ১)

রাখালি গানের মূর্ছনা দিয়ে এ গীতিকাব্য কবিতাটি শুরু হলেও তা পদভ্রমণ করেছে ভিন্ন ভিন্ন দিকে। গ্রাম-চিত্রের বর্ণনায় কবির নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় এবং শব্দ চয়নের নৈপুণ্যে প্রায় সবক’টি কবিতা হয়ে উঠেছে মেদহীন আশ্চর্য সুন্দর। যেমন-

‘এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও-মধ্যে ধু ধু মাঠ

ধান কাউনের লিখন লিখি করেছ নিতুই পাঠ।’ (তদেব)

‘নকশী কাঁথার মাঠ’ দ্বিতীয় কবিতার মধ্যেও আছে এক আশ্চর্য রূপক ও প্রতীক ধর্মিতা। পাশাপাশি পাঠক মাত্রেই এটা লক্ষ্য করবেন সহজ-সরল কথা ও শব্দের রূপ অবয়বে পাঠকদের টেনে নিয়ে যান ভিন্ন আরেক জগতে। মুর্শিদা গানের সহযোগ নিয়ে এ কবিতাটিও নির্মিত লাভ করেছে-

‘এক কালো দতের কালি যা দ্যা কলম লেখি,

আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি,

ও কালা ঘরে রইতে দিলি না আমারে।’ (পৃঃ ৪)

মনে হয় গানের গভীরতর অনুভব দিয়ে পাঠকদের মনকে আরও স্নিগ্ধ প্রাণময় করে তুলতে চেয়েছিলেন। তবে নিবিড় পাঠে আমাদের কখনও কখনও তাও মনে হয় যে, এ কাব্যটির মধ্যে গান ও কবিতার স্বতন্ত্র কোনো মাত্রাচিহ্ন করাটা অনেকটাই বাহুল্যমাত্র। হাতের কাছে এবং চোখের সামনে হাল্কা উপকরণ নিয়ে কবিতার রূপ গড়ে তুললেও তার বিরক্তি ব্যঞ্জক হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে একটি চাষি বালকের উপস্থিতিকে যেভাবে অনবদ্য সার্থক রূপ দিয়েছেন, তাতে যথার্থ অর্থেই তিনি আমাদের স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন। সঙ্গে তার কবিত্ব দীপ্তিকে করে তোলেন আরও উদ্দীপ্ত।

‘এই গায়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল।/কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি-মুখের মায়া,/

তার সাথে কে মাখিয়ে দিছে নবীন তৃণের ছায়া।’ (পৃঃ ৪)

সত্তর পরবর্তী অনেক কবিও তার কাব্য-কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই আশ্রয় করেছে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীর কথাবস্তু এবং নানা কণ্ঠস্বর। পাশাপাশি শব্দের দুরূহতা অনেক ভালো কবিকেও বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় কবি জসিম উদ্দিন আমাদের বড় বেশি সহায়ক হয়ে উঠেছেন। গুরু গম্ভীর আভিধানিক শব্দকে প্রাধান্য না দিয়েও গ্রাম্য-মানুষের সহজতাকে উপলব্ধি করেই; সাধারণ মানুষের উপযোগী করবার জন্যই ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কবি বড় বেশি সহজ ও নরম হয়ে উঠেছেন। আশ্বিন মাসের ঝড় ঝাপটায় মানুষ যেভাবে বিপন্ন হয়েছে তারও আশ্চর্যরূপ বর্ণিত হয়েছে রূপা ও রূশাইয়ের বিপর্যন্ত জীবন যন্ত্রণার নিরিখে। আমরা জানি, সাহিত্যচর্চায় এবং তার চরিত্র সৃজনে প্রত্যেকটি চরিত্র প্রতীকী চরিত্র। আর এরই হাত ধরে বৃহত্তর গ্রাম্য জীবনের আরেকরূপ ধরা পড়েছে এভাবেও-

‘আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে/ গ্রাম ভরা ভর ছুটল ঝাপট লটপটা সব করে।/ রূপার বাড়ির রুপাই ঘরের ছুটল চালের ছানি, / গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি (পৃঃ ১২)/

একটি অঞ্চলের পরিমণ্ডল এবং তার লোকাচার ও সংস্কৃতির সঙ্গে যে কতটুকু আত্মিক সম্পর্ক থাকলে মানুষের প্রতি ভালোবাসা গড়ে ওঠে তারও একটি পুরোপুরি আলাদা ধরনের চিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। কাহিনীর সঙ্গে কবির যে যথার্থই নাড়ির যোগ গ্রথিত আছে তা ধরা দেয় তা কাহিনীর হয়ে ওঠার আশ্চর্য নৈপুণ্যের মধ্যে। রূপাই নামক দুঃখিনী মেয়েটির জীবন যন্ত্রণার মধ্যে কবি যেভাবে নিজের দৃষ্টিকে স্বচ্ছ ও গভীরতর করে রেখেছেন তা থেকে বাংলার পল্লী জীবনের গ্রামকেন্দ্রিক অনুভবকে ধরতে আমাদের কোনোভাবেই অসুবিধে হয় না-

‘খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ, / দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ।/ ঘরে যখন ফিরল রূপা লাগল তাহার মনে, / কী যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে।’ (পৃঃ ১৫)

উনিশ শতকের শেষের দিকের কবি নক্ষত্রেরা যে ধরনের ঘরানাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের কবিতায় জগতকে পরিপুষ্টতার পাশাপাশি আরও বেশি কাঠিন্যের আবরণে চলে গিয়েছিলেন, কবি জসিম উদ্দিন সে দিক থেকে থেকেছেন বড় বেশি নীরব। হয়তো আবহমান পল্লী প্রকৃতির সহজ-সরল জীবনাচরণকে কবি এতই আত্মস্থ করেছিলেন যে, পল্লী বাংলার বাইরে কোথাও তাকে শব্দ চয়নের জন্য যেতে হয়নি। বৃহৎ মাতৃভূমির মধ্যে যে উপকরণ রয়েছে তা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে কবি হয়ে উঠেছেন সহজ শিল্পী।

বহু কবি-শিল্পী তার কাব্য কাহিনীকে রূপদান করলেও কাহিনী এবং সংস্কৃতির সংযোগকে অনেকাংশেই এক জায়গায় একীভূত করতে পারেন না, বরং অনেকটাই অসংলগ্ন রয়ে গেছে। এদিক থেকে আমাদের এ কাহিনীকার পাঠকদের অতৃপ্ত করেননি। নিখুঁত তুলির টানে কাব্যটি হয়ে উঠেছে সার্থক সুন্দর। লোক-সংস্কৃতির মাঝেও লোকজীবনের নিরিখে যে কত সুন্দর ও মননশীল সাহিত্য রচিত হতে পারে আলোচ্য এ কাব্যটি আমাদের সেদিক থেকে পথ-নির্দেশ করে। মেয়ে মানুষের জীবনের ভাষা এবং তাদের সুখ-দুঃখের জীবন যে কবিকে সত্যিকার অর্থেই পীড়িত করত তার ছবি আছে কাব্যটির ভিন্ন ভিন্ন ছত্রে। মনে হয় রূপার ব্যক্তি জীবনকে প্রতীকী অর্থে ধরে নিয়ে তার মধ্যে ব্যঞ্জিত হয়েছে বৃহত্তর জীবনের আর্তি-

‘মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে;

কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে।

গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,

বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস’ (পৃঃ ৫২)

লোকজীবনের এ কবি আলোচ্য কাব্যের নামকরণের প্রসঙ্গটি শেষ দুটি কথায় বর্ণিত করেছেন। মনে হয় সেখানেই অনেকটা ব্যঞ্জিত হয়েছে কাব্যটির যথার্থরূপ। নকশী-কাঁথাটি মেলে ধরে সাজু যেভাবে ব্যথার দিনলিপিকে লিপিবদ্ধ করেছে তাতে তার জীবনের ইতিহাসটাও অন্যভাবে ফুঠে ওঠে:

‘নকশী কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত, আঁকে ছবি,

ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।’

স্বামীর পাশে থেকে যদিও সাজু একদিন বহু যত্ন ভরে নকশী কাঁথাকে পরিপূর্ণ করেছিল, আজ আর সেদিন চলে গেছে বহুদূরে। তাই কবিও সাজুর দুঃখ দুদর্শার চিত্র এঁকেছেন এভাবে-

‘সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,

সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই।’ (পৃঃ ৫৪)

একটি চাষিকেন্দ্রিক জীবন সমাজের রূপচিত্রকে অঙ্কিত করতে গিয়ে এবং নিগুঢ় প্রেমের অনুভবটিকে আরও বেশি ব্যঞ্জিত করে তুলতে নকশী-কাঁথাটি হয়েছে যথার্থ উপযোগী। সময়ের অনুরণন কিংবা মহাসময়ের আশ্চর্যছাপ নৈঃশব্দের মতো কবিতার মধ্যে অবাধে যাতায়াত করে। এগুলোর মধ্যেই রয়ে যায় কবিতা কিংবা কাব্যের প্রকৃত সুর। আলোচ্য কাব্যটিতেও আছে এর বহু সংকেত। যদিও কবি কাব্যটির রচনায় জানিয়েছেন-

‘সারা গায়তার জড়ায়ে রয়েছে সেই যে নকশী-কাঁথা,

আজও গাঁর লোকে বাঁশি বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।

সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নকশী-কাঁথার মাঠ।

ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ।’ (পৃঃ ৫৮)

একটি কাব্যালোচনায় কবি জসিম উদ্দিনের প্রতিভার মূল্যায়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক একটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনার পাশাপাশি কাজটির মধ্যে নিজস্ব আকল্পের সহযোগে পুরোপুরি লোকায়ত ঘরানায় কবি যে নিজস্ব বৃত্ত গড়ে তুলেছেন তা বস্তুত হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্যেরই সহধর্মী। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও কবি জসিম উদদীন সম্পর্কেও এ কথাটারও যেন আশ্বর্য সামঞ্জস্য রয়েছে-

‘সাধনা মৃত্যুর পর লোক সফলতা দিয়ে দিবে;

পৃথিবীতে হেরে গেলে কোনো ক্ষোভ নেই।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত