অনেক শিক্ষিত, জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিমান লোককে বলতে শুনি, বয়স কোনো ব্যাপার না- বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। কেউ কেউ সক্ষমতা বোঝাতে বলে, আমি এখনো দিনে ১৫-১৬ ঘন্টা কাজ করি। বয়সকে পাত্তা না দেয়ার লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
মানুষ নিজেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সক্রিয় এবং কর্মঠ হিসেবে ভাবতেই অনেক পছন্দ করে। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা খারাপ কিছু না। যারা বয়সকে সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করেন তারা মূলত নিজেকে বাস্তবতার বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। নির্দিষ্ট একটা বয়সকে মানসিকভাবে ধারণ করা মানে বয়স বিদ্বেষী একটি মনোভাব পোষণ করা। জন্মের পর থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত শারীরিক বিকাশ হয়ে থাকে। চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে শরীর বৃত্তীয় পরিবর্তন শুরু হতে থাকে। পঞ্চাশ বছর বয়সে সেটি আরো বেশি নজরে আসতে থাকে এবং ষাট বছর বয়স থেকে শরীর শিথিল হয়ে আসে। সত্তুর বছর বয়সে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া সীমিত হয়ে যায়। আশি বছর বয়সকে বোনাস হিসাবে নেয়া উত্তম। সবার শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা একরকম হয় না। কেউ কেউ আশি বছর বয়সে শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্রিয় এবং সক্ষম থাকে। আশি বছর বয়সে এসে গবেষণা, লেখা লেখি, সংগঠন পরিচালনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেখা যায়। এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন। বয়সের সাথে সাথে প্রবীণদের মধ্যে স্ট্রোক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হরমোন, অস্টিউপেরেসিস, আথ্রাইটিস, আলঝাইমার্স, চোখ কানের সমস্যা, ডিপ্রেশনের মতো রোগের দাপট বাড়তে থাকে। অসুস্থ একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। যন্ত্রণাদায়ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের কাছে নিজেকে সক্রিয় সক্ষম হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা আত্ম প্রতারণার সামিল। আমাদের মধ্যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো, সত্য বলার সাহস, সত্যকে সহজে গ্রহণ করতে পারার মতো মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। বয়স আড়াল করার মানসিকতা হলো সত্যকে মেনে নিতে না পারার সংকট। জীবনের প্রতিটি ধাপের সৌন্দর্য, মর্যাদা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস একই রকম হতে পারে না কিন্তু প্রতিটি ধাপের গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জীবন চক্রের মধ্যে রয়েছে বিকাশের পথে বিনাশ।
নিজে যা না তা প্রকাশ করাই আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যিনি লেখা পড়ায়, জ্ঞান বুদ্ধিতে দুর্বল তিনি শিক্ষা বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পন্ডিতি দেখান। যিনি ঘুষ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তিনি বেশি করে মানুষকে সততার সবক দেন। যিনি পরজীবি তিনি মানুষকে শ্রমের মর্যাদার বয়ান দেন। আমরা নিজের চেহারায় সন্তুষ্ট হতে পারি না। গায়ের রং উজ্জ্বল করার জন্য কিংবা ফর্সা ভাব বজায় রাখতে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়। আমরা আমাদের অক্ষমতা, দুর্বলতাগুলোকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি। অন্যের চোখে গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয় হবার আকুলতা প্রবল হচ্ছে। যৌবন আমাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তাই চেষ্টা তদবির করে যৌবনে থাকার প্রবল বাসনা দেখা যায়। বয়স একটি সংখ্যা মাত্র এই কথাটির বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই যৌবনের প্রতি পক্ষপাত। যৌবন হলো ভোগ বিলাস, আবেগ উচ্ছাস, ভাঙ্গা গড়া, ক্ষমতা, শক্তি, দাপটের খেলা। সেজন্য যৌবনে পড়ে থাকার মানসিকতা আমাদের মধ্যে প্রবল। আমাদের মধ্যে বার্ধক্যকে গ্রহণ করে সুস্থ স্বাভাবিক আনন্দপূর্ণ জীবন যাপনের আকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলার অনীহা রয়েছে। জীবন নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা যোগ্যতা খুব মানুষের মধ্যে দেখা যায়। মানুষ নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে রাখতে চায়, না পারলে ক্ষমতার ছায়ায় রাখার চেষ্টা চালায়। সেজন্য মানুষ শক্তিতে সাহসে কর্মে অপেক্ষাকৃত তরুণ হবার বাসনা অন্তরে লালন করে। প্রবীণরা মাঝে মধ্যে মেজাজ হারিয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ, দক্ষ যোগ্য হিসেবে দাবি করতে থাকেন। চাটুকার, মোসাহেবরা উস্কানি দিয়ে বলে, স্যার আপনাকে অনেক বেশি ইয়াং লাগে। এতেই প্রবীণ আনন্দে আটখানা!
বয়স একটি সংখ্যা বলে আত্মতুষ্টি লাভ আখেরে পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে!