গণমাধ্যম, আগামী ও আমরা

রায়হান উল্লাহ

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গণমাধ্যম আগামী দেখায়। বর্তমানকে তুলে আনে; এক সময় তা অতীত হয়। পুরো কাজটি একটি প্রক্রিয়া। আধুনিকতার পরশে এ কাজটিতে যুক্ত থাকেন অসংখ্য মানুষ। তারাই গণমাধ্যমকর্মী। শিরোনামের আমরা। তো সব মিলে গণমাধ্যম, আগামী ও আমরা মিলেমিশে কোথায় যাচ্ছি? কী আছে বর্তমানে? কী দেখাবে ভবিষ্যৎ?

গণমাধ্যম ছুটছেই : আধুনিকতার স্পর্শে গণমাধ্যম যেন গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। এখন কোন বস্তুটি গণমাধ্যমের বাইরে তা নির্ধারণ করা কষ্টের, সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ। বিদ্যুৎহীন কোনো পাড়াগাঁয়ে যখন কোনো নির্যাতন ঘটে, তখন একটি মুঠোফোন সেট হাতে নিয়ে নীরবে তার সাক্ষী হন কেউ। তিনি হয়ে উঠেন একজন লিয়ার লেভিন, হয়ে উঠেন একজন গণমাধ্যমকর্মী। আমরা এভাবেই পেয়ে যাই গণমাধ্যমের অনুষঙ্গ। গণমাধ্যম ছুটছে তো ছুটছেই। এর মাঝেই নাগরিক পিচঢালা পথে একজন অপরাধীকে প্রমাণসহ হাজির করেন নিতান্ত অফিসফেরত কেউ কেউ। তাদের ব্যবহার্য মুঠোফোন সেটটি হয়ে উঠে দলিল। এর দ্বারা তোলা ক্লিপটি হয়ে উঠে অনেক কিছু। এমনকি আদালতের প্রমাণ। শুধুই কী তাই, ওই মানুষজনও যেন চেতনার অনুরণনে ভাবেন তিনি গণমাধ্যমকর্মী। তাই তো যখনই কোনো ঘটনা, তখনই কেউ না কেউ সবিস্তার তার বিবরণী তুলে ধরেন। এভাবেই গণমাধ্যম ছুটে।

কারা গণমাধ্যমকর্মী: এমন বেলায় কারা গণমাধ্যমকর্মী বের করা দুরূহ। বলা যায় এখন গণমাধ্যমকর্মী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। কেউ না কেউ, কোনো না কোনো বিষয়ের প্রমাণ সামনে আনছেন। অথচ তিনি পেশাদার গণমাধ্যমকর্মী নন। কিন্তু কাজের বেলায় গণমাধ্যমকর্মী হয়ে উঠছেন পুরোদস্তুর। তাই তো আমরা প্রমাণসহ পাই কিছু ক্লিপ। পাই আরো অনেক কিছু, যা ওই ঘটনার সব জানায়। আমরা পাই গ্রাম্য বালকের নির্যাতনের চিত্র। অন্য বালক এই সময়ে মহান গণমাধ্যমকর্মী। এভাবেই ¯্রােতে বয়ে যায়। গণমাধ্যম হয়ে যায় ভাবনারও দূরের কোনো বিষয়। তাই ঠিক গণমাধ্যমকর্মী কারা তা এখন আর নির্দিষ্ট থাকছে না।

গণমাধ্যমের আগামী: বয়সের সীমারেখায় দেখেছি গণমাধ্যমের টাইপের যুগ। খটাখট অক্ষর বসে যাওয়া। দেখেছি সাদাকালো যুগ। ক্রমশ রঙিন হয়ে যাওয়া। পৃষ্ঠায় ফুলে ফেঁপে ওঠা। এভাবে গণমাধ্যম এখন একুশ শতকে। মুদ্রণ বিস্ময়ের সময়ে। এখন প্রতিটি মানুষ আজব সব প্রযুক্তি মুঠোয় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এসবই গণমাধ্যম হয়ে ওঠে। সভ্যতা, বিজ্ঞান ও সময় যেভাবে গতিময়তায় বহমান তাতে গণমাধ্যমের আগামী নির্ধারণ দুঃসাধ্য। ভাবনারা বলছে, তা এমন এক জায়গায় দাঁড়াবে যেখানে লোকচক্ষুর আড়াল বলে কিছু থাকবে না। সময়ে মানুষ যন্ত্র পাতবে, তা তুলে আনবে সব।

আমরা কারা: গণমাধ্যমে কাজ করার সূত্র ধরে অনেকেই গণমাধ্যমকর্মী হন। শখের বাইরে গিয়ে যারা এটিকে পেশা হিসেবে নেন। এমন মানুষ গণমাধ্যমকর্মী। এর একজন আমিও। তাই কথা থাকে অনেক। আমরা কে? কী আমাদের যোগ্যতা? কী আমাদের ক্ষমতা? কী আমাদের করণীয়? কী আমরা করছি? কী আমাদের প্রাপ্য? কী পাচ্ছি? কী আমাদের ভবিষ্যৎ? এমন লাখো প্রশ্ন রাখা যাবে। উত্তর আসবে খুবই কম। এর পেছনেও কারণ আছে। শুধুই গণমাধ্যমকর্মী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। আরো এগিয়ে সারাজীবন গণমাধ্যমকর্মী হয়ে থাকা মানুষের সংখ্যাও কম। আসা-যাওয়ার মিছিলের এমন দৃশ্যপট নিয়ে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কতটা সুখের হয়? হচ্ছেও না। তাই নানা কথা আসে। কথারা কষ্ট হয়। এভাবেই আমরা যাপিতজীবনে সুখ-দুঃখ নিয়ে বেড়াই।

আমাদের পরিচয়: চারপাশে অসংখ্য গণমাধ্যম। সবার নানারকম উদ্দেশ্য। মূল উদ্দেশ্যও এক নয়। তাই যতসব ফেসাদ। গণমাধ্যমকর্মীরা নানা মতের ও পথের। এর মাঝেই অনেকে নানা ব্যবসা করেন। শখের মতো গণমাধ্যমকর্মী হন। কিছু সময় গণমাধ্যমে থাকেন। উদ্দেশ্য ফুরালে চলে যান। তিনি অন্যকিছু হয়ে উঠেন। মাঝখানে গণমাধ্যম ও প্রকৃত গণমাধ্যমকর্মীর বারোটা বেজে যায়। আমাদের কেউ কেউ দলীয় হন। কেউ অপরাধী হন। কেউ বা অন্যকিছু হন। প্রয়োজনের সময়ে গণমাধ্যমকর্মী হন। ফলে শিল্পটি ধুঁকে মরে। ধুঁকে মরেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তারা চাহিদার কিছুই পান না। এমনকি পান না কাজ করার পরিবেশ। কিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মী হওয়ার সুযোগই পান না। অথচ তার রক্তে গণমাধ্যম বইছে। তার দ্বারা গণমাধ্যম বহুলাংশে উপকৃত হতো।

কীভাবে এর উত্তরণ : একজন গণমাধ্যমকর্মী অনেক ক্ষমতাধর। তার আছে প্রতিবাদের ভাষা। আছে কলম। লেখার ক্ষমতা। এতসব সদগুণ ধারণ করার মতো একজন মানুষ অপরাধী কিংবা দেশ ও সমাজের শত্রু হতে পারেন না। অথচ আমরা গণমাধ্যমের পরিচয়ে এমন অনেককে পাই। তারা অর্থের বিনিময়ে খবর পাল্টান। আমরা অনেক অপরাধীকেও পাই গণমাধ্যমের বেশে। এর ফলে প্রকৃত গণমাধ্যমকর্মী সবার সন্দেহের দৃষ্টিতে থাকেন। যে কেউ প্রথম পরিচয়েই ভাবেন- বাহ, ভালো তো; আপনি গণমাধ্যমকর্মী। আরো এগিয়ে সাংবাদিক। এ শব্দটি ইদানীং অনেকেই উচ্চারণ করেন এভাবে- সাংঘাতিক। কতটা ভুল সময় পেরোলে একজন সাংবাদিক সাংঘাতিক হয়ে উঠতে পারেন। মধ্যরাতে দু’সাংবাদিককে রাস্তার পুলিশ বলতে পারে এই নিষিদ্ধ সময়ে চা খেতে যাবেন? এই সময়ে সাংবাদিকরা থাকেন খারাপ পাড়ায় কিংবা নেশার ঢেড়ায়। উত্তর দেয়া যায় না। ঠিক ওই সময়েই হয়তো অনেক সাংবাদিক ঠিক ওই কাজগুলো করছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ওই মানুষটি নিশ্চয় ভালো জানেন। তাকে মানুষ ধরে নিয়েই বলছি, ওইসব ‘সাংঘাতিকে’র অন্যায় তারা মেনে নিচ্ছেন। নিজেরাও অন্যায় করছেন। মধ্যে ধুঁকছে গণমাধ্যম। ধুঁকছে সময় ও মানুষ। ধুঁকছি গোবেচারা গণমাধ্যমকর্মীরা। এর উত্তরণ কীভাবে সম্ভব? প্রশ্ন রাখা যাবে। উত্তরও বলা যাবে, কিন্তু পালনের বেলাতেই সব।

গণমাধ্যমকর্মী হওয়ার যোগ্যতা কী: সাংবাদিক যখন সাংঘাতিক হয়ে উঠছে, তখনই প্রশ্ন আসে গণমাধ্যমকর্মী হওয়ার যোগ্যতা কী? যোগ্যতা খুব সহজে বলা যাবে না। এটুকু বলা যাবে, তাকে মোহময় হলে চলবে না। তাকে ক্ষমতা ধরে রাখার কলাকৌশল জানতে হবে। তাকে বুঝতে হবে আমার অক্ষর শক্তিশালী; তাই এর ব্যবহারও হতে হবে সঠিক। এসব হচ্ছে না। তাই আমরা পাচ্ছি সাংঘাতিক। অনেকে বলেন, জানোয়ারলিস্ট। জার্নালিস্টের কী সুন্দর বিবর্তন। প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণমাধ্যমকর্মী হতে কোনো যোগ্যতাই লাগে না। যে কেউ, যেকোনো সময় গণমাধ্যমকর্মী হতে পারেন। এভাবেই দিন যাবে, মাস যাবে, বছর ঘুরে বছর আসবে। তিনি চাইলে এ পেশায় না-ও থাকতে পারেন। আবার এ পেশায় থেকে আরো কিছু করতে পারেন। তাই প্রায়ই কতগুলো বাক্য প্রশ্নের আকারে শোনা যায়- সাংবাদিকতার পাশাপাশি আর কী কী করেন? ঠিকমতো বেতন পান? সংসার চলে কীভাবে? কত সুন্দর প্রশ্নাবলী।

আমরা কী পাচ্ছি: একজন গণমাধ্যমকর্মী হয়ে আমরা অনেক কিছুই পাচ্ছি। কিন্তু পেশা ও চাকরির নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আগামীর পুঁজি পাচ্ছি না। সঠিক সময়ে বেতন পাচ্ছি না। একজন চাকরিজীবীর মতো সব সুবিধা পাচ্ছি না। এর মাঝেও কেউ কেউ সব পাচ্ছেন। রাতারাতি ধনি হচ্ছেন। গাড়ি-বাড়ি-নারী হচ্ছে। তিনি আচমকা গণমাধ্যম ছেড়ে অন্যকিছু দেখছেন। তার উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেছে। এদিকে গণমাধ্যমকর্মী পেটে-মগজে অভাব নিয়ে বসে আছেন। তার আর কিছুই করা হয় না। না ঘর, না সংসার। তার তরে চাকরি ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা হয়ে আসছে না। দিন পেরিয়ে পরবর্তী কর্মদিবসে তার চাকরি থাকছে কিনা তা-ও জানা নেই। ঠিক এই সময়ে কর্মস্থল চালু কিনা তা-ও জানা নেই। গণমাধ্যমের খবরেই আসছে অসংখ্য গণমাধ্যম বেতন-ভাতা দিচ্ছে না মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তবুও ওখানে সাংবাদিক আছেন। তারা চাকরি করছেন। বছর পেরিয়ে বাড়ি করছেন, গাড়ি কিনছেন। অনেক ক্ষেত্রে কিছু না দিয়ে গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও আসছে। এতসব নিয়ে গণমাধ্যমপাঠ সুখের হতে পারে না একজন সৎ গণমাধ্যমকর্মীর জন্য। ফলে ধুঁকে ধুঁকে তিনি এ পেশা থেকে সরে পড়ছেন। এভাবেই গণমাধ্যম ধুঁকছে।  

শেষ কথা: এতসব কষ্ট ও সুখ নিয়েই একজন গণমাধ্যমকর্মী সময় ধরে এগিয়ে চলেন। সময়কে বন্দি করেন কাগজে-ওয়েভে। তার ঘর করা হয় না, দেখা হয় না প্রিয়জন। ঈদে বড়ি ফেরা হয় না। তিনি চষে বেড়ান খবরের খোঁজে। প্রিয় মানুষও তার কাছে খবরের মতো। তাদের খোঁজ রাখেন না তিনি। মন ও মননে ঘুরে খবর। কীভাবে গণমাধ্যম, খবর ও কলমের পবিত্রতা রক্ষা করা যায়। নগরে সে ঘরহীন নাগরিক। কখনো ফাঁকা পকেটে ঘুরে বেড়ান রাস্তায় রাস্তায়। তুলে আনেন না পাওয়ার কষ্ট। তুলে আনেন ঈদে যাদের ঈদ নেই, তাদের গল্প। অথচ তারই যে ঈদ নেই। ঈদের মাসে বেতন নেই, বোনাস নেই। কখনো-সখনো চাকরিই নেই। তবুও তার এসব আনতে হয়। রক্তের নাচনে, পেশার খাতিরে। তিনি হেঁটে বেড়ান রাস্তায়। ফুটপাতে ধাক্কা মারে গণমাধ্যমের কোনো গাড়ি। আচমকা কাদা ছিটিয়ে যায় কোনো বড় সাংঘাতিক। জানালা দিয়ে পড়ে আধখাওয়া দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট। তার পকেটে একটি কমদামি সিগারেট সম্বল। গলির দোকানের দুই মাসের বাকি দেওয়া হয়নি। মেসের খাবার ও বাকি খরচ আনতে হবে বাড়ি থেকে। তবুও তার সুখ লাগে। তিনি একজন সত্যিকার গণমাধ্যমকর্মী হয়ে উঠেছেন। অন্তত মাথায় সারাক্ষণ খবর ঘুরে। এমনই সময় খবর আসে- পরিবার আলো করে এসছে নতুন অতিথি। দেখা হয় না অজানা প্রিয়জনকে। মার ফোন আসে- এবার বাড়ি আসবি না। বাবা বলেন, কিছু টাকা পাঠাতে পারবা? চারপাশে সুখেরা সংসার করে। তার করা হয় না কিছুই। তিনি যে খবরের ঘর করেন। অক্ষরের ঘর করেন। খবরের মায়া ও অক্ষরের মায়া তাকে একদিন সত্যিকার সাংবাদিক বানায়। আর পাওয়ার কিছু আছে কিংবা থাকে? কষ্ট থাকে- গণমাধ্যম যদি একটি শক্ত ভিত পেত। কষ্ট থাকে- গণমাধ্যমকর্মীরা যদি সুখের সংসারে থাকত। তিনি ভাবেন- জগৎজোড়া নাম হবে তার। তিনি একদিন সব বদলে দেবেন। এভাবেই গণমাধ্যম একটি শিল্প হবে, সব গণমাধ্যমকর্মী এর মহান শিল্পী হবেন। মানুষ তার ভাবনার চেয়েও বড়। আশারা বলে-দলে-ফলে যায়। এভাবেই গণমাধ্যম, আগামী ও আমরা একাকার হয়ে যাই। লেখক: কবি ও সাংবাদিক