ঢাকা সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নোমোফোবিয়ায় তরুণ প্রজন্মের ঝুঁকি

অলোক আচার্য
নোমোফোবিয়ায় তরুণ প্রজন্মের ঝুঁকি

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন আপনার স্মার্ট ফোনটি যেখানে রেখেছিলেন সেখানে নেই। আপনি সারাঘর খুঁজেও সেটি পেলেন না। আপনার তখন যে কি পরিমাণ টেনশন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় অথবা বাইরে বেরিয়েও দামি স্মার্টফোনটির চিন্তা থাকে। আমরা এই মোবাইল ফোন নিয়ে এক ধরনের উদ্বিগ্নতায় ভুগে থাকি। বর্তমান সময়ে বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো স্মার্ট ফোন। প্রত্যেকের হাতে একটি স্মার্ট ফোন পৌছে গেছে। সেই সাথে রয়েছে ইন্টারনেট। আজকাল গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই পরিচালিত হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের যেমন ভালো দিক রয়েছে তেমনি আছে খারাপ দিক। এর অতিব্যবহার ক্ষতির কারণও হয়ে উঠছে। বিভিন্নভাবে এটা আমাদের ক্ষতি করছে। স্মার্ট ফোনের অতি ব্যবহার যা আসক্তিতে রূপ নিয়েছে এবং যখন আপনার মনে হবে এটি ছাড়া আর চলছে না তখন এই সমস্যাটিকে একটি নাম দেয়া হয়েছে। সমস্যাটির নাম নোমোফোবিয়া। মূলত নোমোফোবিয়া হলো আপনার অতি প্রিয় ফোন হাতছাড়া হওয়ার ভীতি। আপনার মনে হতে পারে যে ফোনটি আপনার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারে এবং সেখানেই মনোযোগের বেশি অংশ থাকছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যার নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত তারা তাদের ফোনটি ছাড়া নিঃসঙ্গ বোধ করেন। ফোনের সঙ্গে এক অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। আর এর ফলে তারা বাস্তব মানুষের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হন।‘নোমোফোবিয়া’ হচ্ছে ‘নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া’ শব্দগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ। যখন আপনার কাছে মোবাইল ফোন ছিল না তখন এক রকম ছিল। এখন যখন আছে এবং সময়ের বড় অংশই মোবাইল ফোনের সাথে কাটছে তখন মনে হচ্ছে যে ফোন ছাড়া আর চলছে না। ফোবিয়া হলো এক ধরনের ভীতি। আর নেমোফোবিয়া হলো কাছে মোবাইল ফোন না থাকা থেকে সৃষ্ট মানসিক অবস্থা। চলতি বছর এক গবেষণায় উঠে এসেছে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ) চরম মাত্রায় নোমোফোবিয়ায় আসক্ত। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এ আসক্তি সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের মার্চে হেলিয়ন জার্নালে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিলেও একই বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ পায়। গবেষণায় উঠে আসে, মাঝারি মাত্রার নোমোফোবিয়ায় আসক্ত ৫৬ দশমিক এক শতাংশ। আর ৯ দশমিক চার শতাংশ শিক্ষার্থী মৃদু নোমোফোবিয়ায় আসক্ত।গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, স্মার্টফোন প্রাত্যহিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ এবং যুবকদের নিত্যদিনের জীবনে স্মার্টফোন বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করে চলছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত এবং অসচেতন ব্যবহার যুবসমাজকে নোমোফোবিয়ার দিকে ধাবিত করে।

যেটাকে একধরনের ‘মানসিক সমস্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি জরিপের বরাতে জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বলছে, নোমোফোবিয়া সংক্রন্ত এক জরিপে প্রায় ৮০০ জন অংশ গ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকরীদের প্রায় অর্ধেকেই নোমোফোবিয়াতে ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪ শতাংশ গুরুতর ফোবিয়ায় আক্রান্ত। এ থেকে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার মতো রোগের সৃষ্টি হতে পারে। নোমোফোবিয়া সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানী ইভন গ্যোরলিশ বলেন, মোবাইল ফোন সঙ্গে নিতে ভুলে গেলে বা ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে নার্ভাসনেস, ন্যাভিগেশন অ্যাপের নাগাল না পেয়ে ভুল পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয় ও আতঙ্ক এই ফোবিয়ার লক্ষণ। আশঙ্কার কথা হলো, এই সব ভয় কোনো এক সময় শরীরেও প্রভাব ফেলতে পারে।’ আমরা এমন একটা যুগে পৌঁছে গেছি যেখান থেকে প্রযুক্তি অস্বীকার করে পেছনে ফেরার উপায় নেই। ফলে এই মোবাইল ফোনকেও ছাড়তে পারবো না। দৈনন্দিন কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মোবাইল ফোন। আপনার সব তথ্য, সব ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটছে। কিন্তু এই সময় কাটানোই এক সময় মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটাই হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষাথীদের একটি বড় অংশই মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার করছে। মোবাইলের মাধ্যমেই পড়ালেখা, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া অথবা খেলাধূলা সবই ইন্টারনেট কেন্দ্রিক। এটা যেমন সুবিধা এনে দিয়েছে বিপরীতে ক্ষতিও করছে। কিশোর বয়স থেকেই প্রচন্ড মোবাইল আসক্তি তৈরি হচ্ছে যা তার মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিশেষত মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা যেমন সুবিধা পাচ্ছি আবার বিভিন্ন সময় ক্ষতির সম্মুখীনও হতে হচ্ছে অনেককে। নানা চক্র ফাঁদ পেতে বসে আছে। জ্ঞানের বিশাল জগতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মোবাইলের চেয়ে উপযুক্ত প্রযুক্তি আর নেই।

আজকাল হাতে হাতে এন্ড্রয়েট ফোন আর ইন্টারনেট। আমাদের তো এর থেকে দূরে থাকার উপায়ও নেই। প্রযুক্তির অতিব্যবহার ক্রমেই ঘূণপোকার মতো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিঃশেষ করে ফেলছে। স্মার্টফোন এখন শিশু-কিশোরের নাগালেই থাকে। আর নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়া একটা শিশু অনায়াসেই স্মার্টফোন হাতে পায়। সেই সাথে ইন্টারনেট সুবিধা। এই দুটো পাওয়ার পর তারা প্রথমেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। একসময় তারা নোমোফোবিয়াতে আক্রান্ত হয়। যদিও এটি এখনও স্বীকৃত কোনো মানসিক রোগ নয় তবে এর থেকে বেশ কিছু মানসিক সমস্যার তৈরি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ২০০৮ সালের টহরঃবফ শরহমফড়স-এর অন্যতম গবেষণা সংস্থা টএড়া-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রিটেনে প্রায় ৫৩ শতাংশ মোবাইলফোন ব্যবহারকারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যখন তারা ‘তাদের মোবাইল ফোন হারায়, ব্যাটারি বা ক্রেডিট ছাড়ায়, বা কোনও নেটওয়ার্ক কভারেজ থাকে না’। গবেষণায় ২ হাজার ১৬৩ জন লোকের নমুনা থেকে পাওয়া গেছে, প্রায় ৫৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ শতাংশ নারী ভয়াবহভাবে ভুগছেন এবং অতিরিক্ত ৯ শতাংশ লোক মোবাইলফোন বাড়িতে রেখে আসার কারণে মানসিক চাপে পড়েন। জরিপের ৫৫ শতাংশ লোক উল্লেখ করেছেন যে, তারা মোবাইলফোন বাড়িতে রেখে আসার কারণে তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের যোগাযোগ রাখতে পারেন না। এই বিষয়টি তাদের মানসিক উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকায় মোট মোবাইলফোন ব্যবহারকারীর প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যক্তিই তাদের মধ্যে নোমোফোবিয়ার লক্ষণগুলো বিদ্যমান থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বাসায় মোবাইল ফোন রেখে আসা ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মানসিক অস্বস্তিতে ভুগে থাকেন। এমনকি ২৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষেত্রে চালকেরা দুর্ঘটনায় সময় মোবাইলফোন ব্যবহার করে থাকেন বলে পরিসংখ্যান দেখা গিয়েছে। ৬৯ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ঘুম থেকে উঠে কোনো কাজ করার আগে সবার প্রথমে মোবাইল ফোনে হাত দেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডী পার হতে না হতেই সন্তানকে মোবাইল কিনে দেয়। সেক্ষেত্রে অভিভাবক সন্তানের প্রতি তার আবেগের বিষয়টি সামনে তুলে আনেন। কিন্তু সেই মোবাইল তার সন্তানের জন্য আদৌ কোন দরকারী বস্তু কি না তা একবারো যাচাই করেন না। হয়তো সন্তানের প্রতি অতি মমত্ববোধ থেকেই এটা করেন। কিন্তু তাদের খেয়াল রাখতে হবে তার কিনে দেওয়া মোবাইলটা সে কিভাবে ব্যাবহার করছে। আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। এটা সন্তানদের কাছ থেকে অভিভাবকের দুরুত্ব বাড়ার কারণেও হতে পারে। সুতরাং সন্তানকে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। দুরত্ব তৈরি করে নয় বরং ভালোবেসে কাছে টেনে এ কাজটি করতে হবে। মোবাইলের নেশা থেকে নিজেকে ফেরাতে হবে। একটি দুরত্ব রেখে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হবে। অপ্রয়োজনে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার অভ্যাস করতে হবে। মোবাইলে খেলার বদলে বাইরে খেলাধূলার চর্চা করতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর মোবাইল না দেখে বিকল্প স্থানে মনোযোগ দিতে হবে।

অর্থাৎ মেবাইল ফোন এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন তা অভ্যাসে না দাঁড়ায়। তাহলেই এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত