ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শব্দসন্ত্রাস এবং নাগরিক যন্ত্রণা

অলোক আচার্য
শব্দসন্ত্রাস এবং নাগরিক যন্ত্রণা

শব্দ দূষণ নিয়ে একসময় আমাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা ছিল না। এখনও যে খুব বেশি সচেতন আমরা তা নয়। তবে যদি এখনই সচেতন না হই তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। আমাদের চারিদিকে আজ বড় বড় সাউন্ড বক্স বাজে। তার সাথে সাথে উল্লাস। কিন্তু এর ফলে যে আমাদের শ্রবণ শক্তির বারোটা বাজছে সে খেয়াল নেই। শব্দ দূষণের মাত্রা এতটাই যে, এটিকে এখন শব্দ সন্ত্রাস নামকরণ করা যায়। এই সন্ত্রাসে জীবনযাপন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত এই সন্ত্রাসের কবলে পড়তে হয়। সারা দেশে কম-বেশি হলেও সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে আছে রাজধানী ঢাকায় থাকা মানুষ। গাড়ির শব্দ, নির্মাণ কাজের শব্দ, কল-কারখানার শব্দ, মাইকিংয়ের শব্দ ইত্যাদি আরো নানা পদের শব্দ মিলিয়ে অসহ্য অবস্থা তৈরি হয় প্রতিদিন। এরপর দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চলগুলো। যদিও এখন প্রতিটি এলাকাতেই শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। সুতরাং শব্দ দূষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো। তবে রাজধানীতে যেন একটু বেশি মাত্রায় শব্দ দূষণ ঘটছে। সেই বেশি মাত্রা এতটাই সীমা ছাড়িয়ে গেছে যে ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণপ্রবণ এলাকা। শত রকম উৎস থেকে শব্দ দূষণ ঘটছে। যার যেভাবে ইচ্ছা শব্দ দূষণ ঘটাচ্ছে। কেউ গাড়ির হর্ন হাতে চেপে বসে আছে তো আছেই। কারো সমস্যা হলেও বিকার নেই। তার নিজের কানে তো হেডফোন ঝুলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশের সব কয়টি সিটি কর্পোরেশনের শতকরা ৪২ জন রিকশা চালক শব্দ দূষণের ফলে নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছেন। রাজধানী ঢাকায় শতকরা ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ কানে কম শোনেন। দেখা যায়, লেখা আছে সামনে স্কুল, কলেজ বা হাসপাতালের মতো সেনসেটিভ এলাকার সতর্কবাণী; সেখানেও সমানে হর্ন বাজানো চলছে। উচ্চ শব্দে গান বাজছে। মাইক চলছে। একটু আস্তে করলে বা না করলে যেন মান সম্মান থাকছে না। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) আওতায় ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিশ্বে শব্দ দূষণের প্রথম স্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকায় অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকার শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল। অনেক এলাকায় সাইলেন্ট জোনে শব্দ দূষণের মাত্রা ১০০ থেকে ১১০ ডেসিবেল পাওয়া গেছে। এই মাত্রা সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে মানুষ শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে আক্রান্ত হবে এবং শ্রবণশক্তি কমার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হবে। অন্য দূষণগুলোর তুলনায় শব্দ দূষণ সম্পর্কে কম সচেতনতা এবং দুর্বল জ্ঞানের কারণে ক্রমেই শব্দ দূষণ ভয়াবহ রূপে দেখা দিচ্ছে। আমরা এর কুফল পেতে শুরু করেছি। আর তাই শব্দ দূষণ আমাদের দেশে মারাত্মক একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তি এগিয়ে চলার সাথে সাথে আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে চলেছে। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না; আবদ্ধ কোনো স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের তিলোত্তমা নগরী ঢাকা রাজধানী ঢাকা দূষণের সবগুলো মাধ্যমেই মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে। শহরের মানুষগুলো প্রতিদিন দূষিত বাতাস, কানে উচ্চঃস্বরে শব্দ নিয়ে চলাচল করে। ব্যস্ততার একটি অংশ তাদের রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে পার করতে হয়। আর রাস্তায় যে বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয় তার জন্য দুহাত দিয়ে কান চাপা দিতে হয়। শব্দ দূষণ এমনই একটি প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শব্দ যখন শ্রবণ মাত্রার থেকে অতিরিক্ত হয়ে কানের আঘাত করে তখন তাকে শব্দ দূষণ বলা হয়। আর আমাদের চারপাশে এখন এত এত রকম শব্দ হয় যে কোনটা কীভাবে কমবে তার কোনো উপায় নেই। তাই ক্রমাগতভাবে এই সমস্যা বেড়েই চলেছে। ঘরে নিজের টেলিভিশনের অথবা সাউন্ড বক্সের উচ্চ শব্দ মারাত্মক আঘাত করে। আজকাল গ্রামেগঞ্জে বিকট এক সমস্যা প্রকট হয়েছে। এমনকি শহরে এই সমস্যা দেখা গেছে। ডিজে নাম নিয়ে বড় বড় সাউন্ড বক্স উচ্চস্বরে বাজতে থাকে। বিভিন্ন বিয়ে কোন অনুষ্ঠানে টিনএজ বয়সের ছেলেমেয়েদেও এরকম সাউন্ড বক্স বাজাতে দেখা যায়। এতে যে আরেকজনের অসুবিধা হচ্ছে বা হতে পারে তা ভাবার কোনো বালাই নেই। আমি ঠিক জানি না কোন সভ্য দেশে প্রতিবেশীর অসুবিধা করে এরকম আনন্দ উল্লাস করার সুযোগ আছে কি না। তবে আমাদের দেশে এটা হরহামেশাই ঘটে। এতে যে মারাত্মক শব্দ দূষণ হয় বলা বাহুল্য। তারপর আবার একালের প্রজন্ম রাস্তাঘাটে কানের ভেতর হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে রাস্তা পার হয়। আবার দীর্ঘ সময় কানের সাথে মোবাইল ফোন লাগিয়ে কথা বললেও শব্দ দূষণ ঘটে। ২০১৭ সালে দেশে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হয়। শব্দদূষণ আইন অনুযায়ী হাইড্রোলিক হর্ন বাজালে দুইশ’ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগ কোথায়? আর এই আইন জানেই বা ক’জন। সোজা কথা শব্দদূষণ নিয়ে আমাদের দেশে কেবল হাতে গোনা মানুষই জানে। এই উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ তৈরি করে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬-এর বিধি-১৭ ও ১৮ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। রাস্তায় বের হলেই বাস ট্রাক প্রাইভেট কারের বিরক্তিকর হর্নে কানের বারোটা বেজে যায়। বেশিরভাগ সময়ই এসব হর্ন দেয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই।

একসময় শব্দদূষণ ততটা মারাত্মক ছিল না কারণ তখন এত যান্ত্রিকতা ছিল না। বরং সে সময় প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আর এখন যান্ত্রিকতা যত এগিয়ে চলেছে প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্ক ততই কমতে শুরু করেছে। ফলে শব্দ দূষণের কুপ্রভাব আমাদের ওপর ভালোই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। খুব সম্ভবত পরিবেশ দূষণের অন্যান্য দিক যেমন মাটি দূষণ, পানি দূষণ বা বায়ু দূষণ রোধ করার চেয়ে শব্দ দূষণ রোধ করা বেশি সহজ। আমরা যারা শব্দ দূষণ করে চলেছি তারা একটু সচেতন আর সদিচ্ছা করলেই শব্দ দূষণ সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারে। বড় বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা থাকে সামনে স্কুল বা সামনে হাসপাতাল। ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচ ভাগে বিভক্ত এলাকায় সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হলেও গত বছরের তথ্যে, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন গবেষণায় দেখা গেছে, সব এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ সীমার থেকে দেড় থেকে দ্বিগুণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি জটিল রোগের অন্যতম প্রধান উৎস শব্দ দূষণ। ক্রমাগত বাড়তে থাকা শব্দের মাত্রা আগামীতে অসুস্থ প্রজন্ম জন্ম দিবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আকস্মিক উচ্চশব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়। এছাড়া শ্রবণশক্তি কমে আসে বা বধির হওয়ার মতো অবস্থা হয়। মাথাব্যাথা, বদহজম, অনিদ্রা, মনোযোগ কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অযথা বিরক্তিবোধ এমনকি নানাবিধ মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করতে হবে যাতে অযথা হর্ন বাজাতে না পারে। আবার উচ্চস্বরে শব্দ সৃষ্টি করে যা মানুষের শ্রবণ শক্তির বারোটা বাজায় তা রোধ করতে হবে। রাজধানীবাসীসহ সারা দেশের মানুষকে শব্দদূষণ থেকে মুক্তি দিতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। না হলে দুর্বল শ্রবণশক্তিসহ অন্যান্য জটিল রোগ মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত