ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.) : জীবন ও কর্ম

মাহমুদ সালেহীন খান
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.) : জীবন ও কর্ম

আজ ১৯ রমজান। ইংরেজি ২০১৬ সাল। ১৯ রমজান। সারা দিন খুব উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা নিয়ে গ্রীণ রোডের একটি হাসপাতালে পরিবারের সবাই বসে আছি। আসরের নামাজ জামাতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মামাদের ডাক এলো আইসিউতে। আইসিউর বেডে শুয়ে আছেন অর্ধশতাব্দী ধরে ইসলামের খেদমত করা জীবন্ত কিংবদন্তী মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.)। যন্ত্রের হার্টবিটের দিকে আমরা তাকিয়ে জোরে জোরে কালেমা পড়ছিলাম। ঠিক মাগরিবের আগমূহুর্তে যন্ত্রটি স্টপ হয়ে গেল। চিকিৎসক তার হাত ধরে বললেন, তিনি আর নেই। সেই সময় হাসপাতালে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমরা সবাই। আমাদের পরিবারের বটবৃক্ষ, দেশ ও জাতির বটবৃক্ষ মাওলানা মুহিউদ্দিন খান আর নেই। মুহূর্তে সারা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ল। হাসপাতালে ছুটে আসতে শুরু করলেন বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বীনের অসংখ্য ভক্তানুরাগী। আমার সৌভাগ্য মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.) এর রক্তের ধারায় পৃথিবীতে মহান আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। দেখতে দেখতে কীভাবে নয় বছর কেটে গেল! তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, বৈচিত্র্যময় গুণী এই মানুষটির কথা কে না জানেন। তার অবদান সম্পর্কেও কমবেশি সবার জানা। তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনের অনুবাদ লিখে সবার মাঝে বেশ বড়সড়ো জায়গা করে নিয়েছেন। রাজনীতি ও লেখালেখির বিস্তৃত মঞ্চে সমান তালে হেঁটেছেন জীবন-বিপ্লবের বাঁকে বাঁকে।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, জন্ম ৭ বৈশাখ ১৩৪২ বাংলা, জুমার আজানের সময় ময়মনসিংহের মাতুলালয়ে। ইসলামি সাহিত্য সাংবাদিকতা জগতে তিনি কিংবদন্তি। বাংলা ভাষায় সিরাত চর্চা প্রবর্তন, মাআরেফুল কুরআনের অনুবাদ, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো দুষ্প্রাপ্য ও উচ্চাঙ্গের কিতাবাদি সহজ-সরল, সাবলীল ভাষায় সবার বোধগম্য করে প্রকাশ করে তিনি আমাদের কাছে দূর আকাশের দীপিত তারকা। এছাড়া বংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি, তাহজিব তামাদ্দুনের তিনি ছিলেন পুরোধা। জাতীর এক মহান রাহবার।

মাওলানা মহিউদ্দীন খান গোটা পৃথিবীর দুয়েকজন বিরল সম্মানের অধিকারী মুসলিম মনীষীদের অন্যতম। যার প্রতিটি কথা হয় গ্রন্থিত। জীবনের প্রতিটি দিক একেক ইতিহাস। প্রতিটি বক্তৃতা সংকলিত। রচিত পুস্তক হয় চিরন্তন সাহিত্য। চিন্তার প্রতিটি ক্ষণ হয়ে ওঠে দিব্যদৃষ্টির বার্তা। উপলব্দি ও মূল্যায়ন হয় ইতিহাসের আক্ষরিক পথ নির্দশন।

লেখনি ও সম্পাদনার কাজে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন বহুবিস্তৃত দূর সীমানায়। সম্পাদনা করেছেন মাসিক মদীনা। সম্পাদিত, অনূদিত ও সংকলিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। সংকলিত যেমন : রওযা শরীফের ইতিকথা, দরবারে আউলিয়া, হায়াতে মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও দেওবন্দ আন্দোলন, কুড়ানো মানিক [১-৪ খণ্ড], কোরআন পরিচিতি, আধুনিক বাংলা-আরবি এবং আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান আল-কাউছার, অনূদিত যেমন : মাওলানা ফযলে হক খয়রাবাদী কৃত আযাদী আন্দোলন, শহীদ হাসানুল বান্নার রচনাবলী, ইমাম গাজালীর [৪৫০-৫০৫ হি.] জগত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইয়াহইয়াউ ঊলুমিদ্দীন [১-৫ খণ্ড], উপমহাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস শায়খ শারফুদ্দিন আবু তাওয়ামার ছাত্র শায়খ ইয়াহইয়া মুনায়েরী কৃত মারেফাত জ্ঞানের রত্ন ভাণ্ডার, জালালুদ্দীন সুয়ূতী [৮৪৯-৯১১হি.] কৃত বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ খাসায়েসুল কুবরা, মুফতী ইয়ার মুহাম্মদুল্লাহ খান কৃত দালায়েলুস সুলূকের অনুবাদ ইসলামী তাছাউফের স্বরূপসহ আরও অনেক গ্রন্থের কাজ তিনি সফলভাবে সম্পাদনা করেছেন।

ষাটের দশক থেকে তিনি বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি মাওলানা আতহার আলী রহ. প্রতিষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় দায়িত্বে সমাসীন ছিলেন। পরবর্তীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জোরদার আন্দোলন চালিয়ে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর ঢাকার পটুয়াটুলী জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় জমিয়তের কাউন্সিলে তিনি জমিয়তের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এই অধিবেশনেই তানজিমুল মাদারিস গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চ জমিয়তের সহ-সভাপতি এবং ২০০৩ সালের ১ জুন নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হন।

এছাড়া তার আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের প্রতিষ্ঠাতা। রাবেতা আলমে ইসলামীর কাউন্সিলর। মু’তামারুল আলম ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট। জাতীয় সিরাত কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামী মোর্চার সভাপতি। ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রধান।

তার জীবনের একান্ত ইচ্ছা ছিল, বাংলা ভাষায় এদেশের আলিমরা বড় মযবুত ও শক্ত একটা ভাষার ভীত যেন তৈরি করে যায়। তার স্বপ্ন পূরণের গুরুদায়িত্ব তিনি আলিমদের দিয়ে গেছেন। বংশ পরম্পরায় নির্মাণ করে গেছেন স্বপ্নীল ভবিষ্যৎ।

আধুনিক বিশ্বের চিন্তা, গবেষনা, ইসলামি জাগরণ আর কর্ম সাধনার অন্যতম পুরুষ। যার লেখা গ্রন্থ ইউরোপের শ্রেষ্ট বিদ্যাপিঠ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। বাংলাদেশে তিনিই কেবল ‘খানায়ে কাবা’র তেতরে প্রবেশ করে নামাজ পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি বহুমুখী কর্মতৎপর একটি সফল প্রতিষ্ঠান । আসুন এক নজরে বিশ্বব্যাপী তার বিশাল কর্মযজ্ঞ জীবন সম্পর্কে জেনে নেই।

ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠা : পাকিস্তান আমলেই তিনি ঢাকাতে ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। সরকার যা পরবর্তিতে অধিগ্রহণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর যা পরবর্তিতে সরকার ইসলামী ফাউন্ডেশন নামে রূপান্তরিত করেন।

আধুনিক বাংলা ইসলামি সাহিত্যের নির্মাতা : আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ইসলাম চর্চার পথিকৃৎ তিনি? তাকে অনুসরণ করে এবং তার পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে এদেশে অসংখ্য লেখক অনুবাদক ও গবেষক তৈরি হয়েছেন?

মাসিক মদীনা : বাংলাদেশের সম্ভ্রান্ত এমন কোন মুসলিম পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের ঘরে মাসিক মদীনার একটি কপি পৌঁছেনি। ষাটের দশকের প্রথম দিকে ১৯৬১ সালে তার প্রতিষ্ঠিত মাসিক মদীনা পত্রিকা এদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা। দেশে-বিদেশে যার পাঠক সংখ্যা কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় ইসলামী পত্রিকার নতুন এই ধারার পথপ্রদর্শক তিনি। তার অমর কীর্তি মাসিক মদীনার অনুকরণে অনেকগুলো ইসলামী ম্যাগাজিন এদেশে পরবর্তিতে চালু হয়ছে?

সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান : উম্মাহর চিন্তা ও বাঙালি মুসলমানের সুখ দুঃখের কথা ফুটিয়ে তুলতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান। এটাও বাংলা ভাষা ও সাংবাদিকতায় প্রথম কোন ইসলামি ধারার সাপ্তাহিক। তার স্বপ্ন ছিল দৈনিক মুসলিম জাহান তৈরির । সামাজিক বৈরি পরিবেশ ও রাজনৈতিক হিংস্রতার ফলে দৈনিক মুসলিম জাহান প্রতিষ্টা না করতে পারলেও সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের মাধ্যমে যে কর্মী বাহিনী ও কলম সৈনিক তিনি তৈরি করেছিলেন তারাই পরবর্তিতে জাতীয় দৈনিক ও মিডিয়াতে এখন সাব এডিটরসহ সাংবাদিকতায় অনেক বড় অবস্থানে কাজ করছেন।

মদীনা পাবলিকেশন্স : তার অমর কীর্তি ঐতিহ্যবাহী মদীনা পাবলিকেশন্স। মকসুদুল মুমিন আর নেয়ামুল কোরআনের অশুদ্ধ পাঠ চর্চা থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যের ইসলামি বিশাল ভাণ্ডারের সাথে। শুধু ইসলামি বইকে বটতলা থেকে আধুনিককরণই করেননি বরং আজ থেকে অর্ধ শতাব্দি আগে এমন মান ও শৈল্পিকতার সাথে ইসলামী বইয়ের সমাহার নিয়ে একটি প্রকাশনির যাত্রা করলেন তখন বাম পাড়াতেও এমন মানসম্পন্ন প্রকাশনা চোখে পড়েনি। মদীনা প্রাবলিকেশন্সের পথ ধরে পরবর্তিতে শতশত ইসলামী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে? বাংলা বাজারে ইসলামি টাওয়ার আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ইসলামি বই বাজার নিয়ে। এর পেছনে যে মানুষটি শক্তি সাহস ও প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন তিনি মাওলানা মহিউদ্দীন খান। মদীনা পাবলিকেশন্স শুধু বাংলা একাডেমি ২১শে বই মেলাতে নয় কলকাতা ও সৌদি বইমেলাতে অংশগ্রহণ করে আমাদের মুখোজ্জ্বল করেছেন।

রাবাতে আল আলম ইসলামী : বিশ্বের বরেণ্য ইসলামি স্কলার ও পণ্ডিতদের আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানের তিনি বাংলাদেশের প্রথম সদস্য। দীর্ঘদিন রাবেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সংস্থার নির্বাহী পর্ষদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে আরব বিশ্ব ও বিশ্বের বড় বড় পণ্ডিতদের সাথে তার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। রাবেতার মাধ্যমে এদেশে অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা দাতব্য চিকিৎসালয় তিনি তৈরি করেছেন।

বিনামূল্যে কোরআন বিতরণ : সংক্ষিপ্ত মারিফুল কোরআনের অনুবাদ ও সৌদি বাদশা ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজের সৌজন্য ও মাওলানা মহিউদ্দীন খানের তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষাভাষি মানুষদের জন্য কোটি কপি মারিফুল কোরআন তরজমা ও কোরআন শরিফ বিনামূল্যে কয়েক যুগব্যাপী বিতরণ তার এক অসামান্য মকবুল একটি খেদমত।

মদীনা ইউনিভার্সিটির স্কলার : বিশ্বখ্যত মদীনা ইউনিভার্সিটির একজন সম্মানিত স্কলার ও ভিজিটিং প্রফেসার মাওলানা মহিউদ্দীন খান। তার সত্যায়ন ও সুপারিশে অগণিত বাংলাদেশি যুবক মেধাবী শিক্ষার্থী আল আজহার কিংবা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে? যা বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে এক অসামান্য অবদান তৈরি করেছে।

অনুবাদ : বিশ্বসাহিত্যের ইসলামি গ্রন্থকে বাংলা অনুবাদের এই মহান কাজটি তিনিই প্রথম শুরু করেন। দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী, ইবনে তাইমিয়াসহ বিশ্বের বড় বড় মুসলিম লেখককে তিনিই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন বাঙালি মুসলমানদের সাথে। এহিয়ায়ে উলুমদ্দীন, কিমিয়য়ে সাদত, মুর্শিদুল আমিন, বার্নাবাসের বাইবেলের মতো গ্রন্থ তিনি অনুবাদ ও প্রকাশ করেছেন। মুফতি শফি রহ. তাফসিরে মারিফুল কোরআনের মতো বিশাল গ্রন্থ ১০ খণ্ডে তিনি অনুবাদ করেছেন এককভাবে। এছাড়া অসংখ্য আরবি উর্দু ফার্সি ইংরেজি গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছেন।

মৌলিক রচনা : অর্ধশতের উপরে তিনি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছন। তার অসামান্য আত্মজীবনী গ্রন্থ জীবনের খেলাঘর বাংলা সাহিত্যে বহুল পাঠিক একটি ক্লাসিকেল গ্রন্থ। স্বপ্নযুগে রাসুল সা. তার লিখিত একটি জনপ্রিয় গ্রন্থ। রওজা শরিফের ইতিকথা গ্রামবাংলায় বহুল পাঠিত একটি গ্রন্থ। এছাড়া তার লিখিত শতাধিক গ্রন্থ বাংলা ভাষার পাঠকরের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ।

নওমুসলিম পুনর্বাসন কেন্দ্র : গরিব, অসহায় অসংখ্য নওমুসলিমকে তার প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেছেন। খিষ্টান মিশনারির বিকল্প দাওয়াতের কাজে অমুসলিমদের মাঝে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক সফলতা তৈরি করে। বাংলাদেশ নওমুসলিম পুনর্বাসন আইডিয়াটি তিনিই প্রথম তৈরি করেন।

সিরাত চর্চার পথিকৃৎ : বাংলা ভাষায় সিরাত চর্চার পথিকৃত মাওলানা মূহিঊদ্দীন খান । মাসিক মদীনা, মুসলিম জাহানের সিরাতুন্নবী সংখ্যা বিশাল কলরবে ঈদ সংখ্যার মতো প্রকাশ করার আইডিয়ার জনক তিনি। তিনি মদীনা পাবলিকেশন্সের মাধ্যমে অসংখ্য সিরাত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। রাসুলে পাক সা. এর সিরাত চর্চায় বাংলা ভাষায় কেন বিশ্ব সিরাত সাহিত্যের তিনি প্রাণপুরুষ।

জাতীয় সিরাত কমিটি : তার মহান কার্যক্রমের অন্যতম জাতীয় সিরাত কমিটি। এর মাধ্যমে জাতীয়ভাবে সিরাত চর্চা। সিরাত সম্মেলন । জাতীয় সিরাত স্মারক এপর্যন্ত ৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। যা বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল অবদান তৈরি করেছে। তিনি জাতীয় সিরাত কমিটির চেয়ারম্যান।

সিরাত স্বর্ণ পদক : তার অসামান্য অবদানের একটি সিরাত স্বর্ণ পদক। সিরাত চর্চাকে উৎসাহিত করতে এবং যারা সিরাত চর্চা ও সিরাত সাহিত্য অবদান রেখেছনে এরকম অসংখ্য মনীষাকে তিনি মূল্যায়িত করেছেন এই পদক প্রদান করে। খতিব উবায়দুল হক রহ. আল্লামা আহমদ শফিসহ অনেক বিখ্যাত জনরা এপদকে ভূষিত হয়েছেন।

আগ্রাসন প্রতিরোধ কমিটি : মাওলানা মহিউদ্দীন খান দেশ মাতৃকার এক জাগ্রত সিপাহসালার। তিনি এই আলোচিত সংগঠনটির মাধ্যমে সামরাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করেছেন আজীবন। তার নেতৃত্বে এই অরাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডানপন্থি বুদ্ধিজীবী লেখকদের একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন।

আনসার নগর কমপ্লেক্স : খান সাহেবের পিতা হাকীম আনসার উদ্দীন খানের নামে ময়মনশাহীর গফরগাঁও আনসার নগর এক সুবিশাল শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা করেছেন। এতিমখানা, মাদ্রাসা, মহিলা মাদ্রাসা, ইসলামিক স্কুল, সেবা ট্রাস্ট, হাসপাতাল, মসজিদ, গণপাঠাগারসহ বহুমুখী কার্যক্রম তার অমর কৃর্তি।

সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব : তিনি চলন্ত এক বিশ্বকোষ। মাসিক মদীনাকে ঘিরে তিনি যে প্রশ্নোত্তর বিভাগ চালু করেছিলেন তা, খান সাহেবের এক অমর জ্ঞান ভান্ডার। প্রতি মাসে শতাধিক প্রশ্ন উত্তর নিয়ে এই বিশাল আযোজন ছিল মদীনা পত্রিকার মূল আর্কষন। এককভাবে বিগত ৭০ বছর ধরে কয়েক লক্ষ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। মহাকাশ, বিজ্ঞান, ফেকাহ, কোরআন, হাদীস, মনীষা, বিভিন্ন সভ্যতা, এমন কোনো বিষয় নেই যার উত্তর তিনি দেননি। ‘সমকালিন জিজ্ঞাসা’ জবাব নামে যা শতাধিক খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। যা বিশ্ব ইতিহাসে একক এক বিশ্বকোষ বা জ্ঞান ভাণ্ডারের মর্যাদা লাভ করেছে।

রাবেতা আল আদব : বিশ্ব ইসলামি সাহিত্য পরিষদের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠা। সৌদি আরবের রিযাদকেন্দ্রীক আন্তর্জতিক এই সাহিত্য সংগঠনটির মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে সাহিত্য চর্চার ইসলামিক ধারার নব যুগের সূচনা করে বিশ্ব দরবারে অমর হয়ে আছেন। রাবেতা আল আদবের মাধ্যমে কিনি পৃথিবীর সবক’টি মুসলিম দেশ সফর করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বহুদেশ ভ্রমণ করে তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ব্যব্যাপী মানব সভ্যতার নির্মাণ ও বিকাশ সম্পর্কে বহু গ্রন্থ লিখেছেন।

ইসলামী পত্রিকা পরিষদ : বাংলাদেশের সব ইসলামী পত্রিকার সমন্বয়ে ইসলামী পত্রিকা পরিষদ গঠন তার অমর কৃর্তি। জাতীয় লেখক সম্মেলন, লেখক পুরস্কার তার অমরকৃর্তি।

টিপাই মুখ লংমার্চ : নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে তিনিই প্রথম ভারতীয় নদী আগ্রাসন ও টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। তার নেতৃত্বে লাখো জনতার টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী টিপাইমুখ অভিমুখে লংসার্চ মুহিউদ্দীন খানের জীবনের ঐতিহাসিক নেতৃত্বের সফলতা।

বাংলাদেশ সবোর্চ্চ উলামা পরিষদ : বাংলাদেশের সব মত পথের আলেমদের নিয়ে সর্বোচ্চ উলামা পরিশদ গঠন খান সাহেবের অনন্য ব্যক্তিত্বের আরেকটি মাইলফলক। দেওবন্দি, ছারছিনা, ফুলতুলি, বায়তুশ শরফসহ নানা মতের উলামাদের নিয়ে ইসলামবিরোধি যে কোনো কাজে তিনি প্রতিবাদ করেছেন।

এবং আজীবন উলামাদের ঐক্য ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের পক্ষে কাজ করেছেন। কার দরবার সব মত পথের আলেমরা আশ্রিত হবার শেষ ঠিকানা।

মাসিক মদীনার মাধ্যমে তিনি যে লেখক কাফেলাকে এদেশে এক বিনি সুতার মালায় গেথে ছিলেন, তারাই মূলত এদেশের তাহযিব তমদ্দুন সংরক্ষণ বিকাশ ও লালনে অসামান্য অবদান রেখেছেন। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খা, কবি ফররুখ আহমদ, কবি বন্দে আলী মা, নুর মোহাম্মদ আজমি, দেওয়ান আব্দুল হামিদ, অধ্যাপক আবু তালিব, সৈয়দ আব্দুস সুলতান, সৈয়দ আশরাফুল হক আকিক, এজেড শামছুল আলেম সিএসপি, আব্দুল খালেক জোয়ারদার, জহুরী, কবি মুজ্জাম্মেল হক, ইতিহাস গবেষক সৈয়দ আব্দুল্লাহ, কবি আব্দুল হালিম খা, অধ্যাপক আবুল হোসেন মল্লিক, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ড. আফম খালেদ হুসেন, মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী, মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ, উবায়দুর রহমান খান নদভী, মাওলানা লিয়াকত আলী প্রমুখের এই কাফেলা তিনি মদীনা পত্রিকার মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন।

কিংবদন্তির কলম সৈনিকের এক কাফেলা। তাদের অনেকেই আজ নেই। তবে তাদের কর্ম আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত