ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদযাত্রা : আনন্দের ঈদ যেন বিষাদে পরিণত না হয়

আজহার মাহমুদ
ঈদযাত্রা : আনন্দের ঈদ যেন বিষাদে পরিণত না হয়

মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে আনন্দ, খুশি। আর সেই আনন্দ ভাগাভাগি করতে পরিবারের পাশে থাকতে চায় সবাই। নাড়ীর টানে বাড়ি ফিরে সবাই। যারা দূরে থাকেন তারাও শহর-নগর ছেড়ে শিকড়ের টানে পরিবারের কাছে ছুটে যান। এটি আবহমান কাল থেকে একটি চিরায়ত দৃশ্য। অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমনটা হয়ে থাকে সবসময়। তাছাড়া এদেশের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, টান এসবের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছা করলেই এই বাড়ি ফেরা কিংবা পরিবারের কাছে ফেরাটা স্বস্তির সাথে হয় না। ঈদপূর্ব যাত্রায় সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে চলাচল নির্বিঘ্ন থাকে না। বিশেষ করে সড়কপথে যাতায়াতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে সাধারণ মানুষের। দেশের চারটি প্রধান মহাসড়কে এখনও শৃঙ্খলা ফিরেনি। সড়ক দুর্ঘটনা এখনও এসকল সড়কের নিয়মিত বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশরাও দায়িত্ব পালনে হিমশিম খায়। সেক্ষেত্রে ঈদযাত্রায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা তাদের পক্ষে আরও কঠিন।

প্রতিবারের মতো এবারের ঈদে যাত্রীদের বড় অংশ যানবাহনের সংকটে পড়তে পারে।

এর সঙ্গে যোগ হবে পথের ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে মহাসড়কগুলো এই ভার বহন করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রতিবছরই মহাসড়কগুলো চলাচলের উপযোগী করার নির্দেশ দেন, ব্যবস্থা নেন বলে জানান।

কিন্তু এসব কথা আদৌ কতটা বাস্তবায়ন হয় সেটাই বড় প্রশ্ন। তাছাড়া ঈদের সময় অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো হাইওয়েতে চলাচল করে। সঙ্গে যোগ হয় অতিরিক্ত গাড়ির চাপ। যার ফলে সৃষ্টি হয় বড় ধরনের যানজট। এতে ঘর ফেরা মানুষের ভোগান্তি উঠবে চরমে। ঈদে যানজটে নাকাল হয়ে ছয় ঘণ্টার পথ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টায় পৌঁছায় যাত্রীরা, অনেক ক্ষেত্রে একদিনও লেগে যায় বড় দুর্ঘটনা হলে। তাছাড়া ঈদযাত্রায় প্রতিবছরই দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। কত-শত প্রাণ যে সড়কে হারায় সেটার হিসেব নাই।

আকাশপথে ভ্রমণের সক্ষমতা অনেকেরই নেই। যাদের আছে তারা হয়তো নির্বিঘ্নে যাতায়াত করবেন। কিন্তু পানিপথে আর সড়কপথে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে গন্তব্যে পৌঁছাবার এই চেষ্টা এদেশের মানুষের আর কতকাল করে যেতে হবে সেটাই প্রশ্ন। ঈদযাত্রায় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, সড়কের বেহাল দশা, দীর্ঘ যানজট, টিকিট কালোবাজারি, নিয়ন্ত্রণহীন ভাড়া বৃদ্ধি, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জালনোট, সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ যখন চরমে ওঠে, তখন ঘরমুখো মানুষের মনে হতাশা জন্ম নেয়। অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত, দেশের কোনো পথই ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ ঈদের আগে সবখানেই পোহাতে হয় ভোগান্তি। তাছাড়া এবার রেলের টিকেট নিয়েও শুরু হয়েছে বড় ভোগান্তি। এছাড়া ঈদযাত্রায় মৃত্যুর মিছিল তো আছেই। সর্বশেষ গত বছরে কুরবানির ঈদে মানুষ বাড়ি ফিরেছে, এবং কর্মস্থলে এসেছে। সেই ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে ১৩ দিনে ঝড়েছে ২৬২ প্রাণ। এতে আরো ৫৪৩ জন হয়েছে বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

এছাড়া গতবছরের পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে-পরে সড়ক, রেল, নৌপথে সর্বমোট ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে সড়ক-মহাসড়কেই ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও এক হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়াও ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রীদের ক্ষতি করতে বিভিন্ন চক্র ওঁৎ পেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এসব চক্রের সঙ্গে পরিবহন কর্মচারীদের যোগসাজশও থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে উৎসব-পার্বণে যাত্রী ও ক্রেতাকে বিশেষ ছাড় দেয়া হলেও আমাদের দেশে হয় উল্টো। প্রায় সব পরিবহনেই টিকিটের দাম বৃদ্ধি করা হয়। যাত্রীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়, যা সত্যি দুঃখজনক।

ঈদ উপলক্ষে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে যে কয়েকগুণ বেশি মানুষ চলাচল করে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ আদৌ কতটা গুরুত্ব দেন সেটা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। ঈদের আগে কিছু ট্রেনের বগি বাড়িয়ে, সড়কে লোক দেখানো কাজ করেই তারা দায়িত্ব শেষ করে দেন। ফলে ঈদযাত্রায় সাধারণ মানুষজন শুধু দুর্ভোগেরই শিকার হয় না, বহু পরিবারে ঈদের আনন্দ বিষাদেও পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈদের সময় বর্ধিত বিপুলসংখ্যক যাত্রীর চলাচল সামাল দিতে প্রয়োজন টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু এরূপ পদক্ষেপ কখনও দেখেনি দেশের মানুষ, আর ভবিষ্যতে দেখবে বলেও বিশ্বাস করতে পারছে না তারা। এরপরও সাধারণ মানুষ চায় তাদের ঈদযাত্রা যেন নির্বিঘ্ন হোক। স্বস্তিতে, নিরাপদে মানুষ আপনজনের কাছে ফিরতে চায়। ঈদ শেষে আবার স্বস্তিতে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে চায়। এই নিশ্চয়তা তাদের এখনও দিতে পারছে না প্রশাসন। এটাই বড় দুঃখের বিষয়।

পরিশেষে বলতে চাই, ঈদের আনন্দ হোক সবার জন্য। প্রশাসনের নিকট প্রত্যাশা ঈদের আনন্দ যেন বিষাদে রূপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়াও আমাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে জনসচেতনতাই পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ঈদযাত্রায় সবার জন্য রইল দোয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত