ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিনে গণহত্যার দ্বিতীয় পর্ব

আক্তার মনি
ফিলিস্তিনে গণহত্যার দ্বিতীয় পর্ব

ইসরায়েল ১৫ মাস ধরে মিথ্যা প্রচারণার মধ্য দিয়ে গণহত্যার পক্ষে পশ্চিমাদের সমর্থন টিকিয়ে রেখেছিল। দেশটি হামাসের যুদ্ধাপরাধ, যেমন শিশুর শিরশ্ছেদ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো কথা বললেও কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। বিপরীতভাবে ইসরায়েল হামাসের প্রতিক্রিয়ার জবাব দিতে গিয়ে গুরুতর যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) অনুসারে, ইসরায়েলি নেতারা একটি নতুন যুদ্ধের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার মরিয়া চেষ্টা করছেন। ফিলিস্তিনে গণহত্যার দ্বিতীয় ধাপ বলতে সাধারণত ইসরায়েলি বাহিনীর ফিলিস্তিনের গাজা, ওয়েস্ট ব্যাংক এবং পূর্ব জেরুজালেমে চলমান আক্রমণ, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বুঝানো হয়। বিশেষ করে ২০২১ সালে গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ সংঘর্ষের পর, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে এই ধরনের গণহত্যার অভিযোগ ওঠে।

ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং প্রতিরোধকারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণের কারণে হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নাগরিকের মৃত্যু হয়, অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, স্বাস্থ্যসেবা এবং বেসামরিক অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার এ ঘটনাগুলোকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তবে ‘গণহত্যা’ শব্দটি আন্তর্জাতিক আইনে একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বহন করে, যার মধ্যে জাতিগতভাবে কোনো জনগণকে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ধ্বংসের চেষ্টা অন্তর্ভুক্ত। এই ধরনের অভিযানগুলোর জন্য, বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের নীতিমালা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। এটি একটি অত্যন্ত জটিল এবং বিতর্কিত ইস্যু, যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত বিভিন্ন দিক মিশে থাকে। গণহত্যা আবার শুরু করার ন্যায্যতা দিতে তাদের নতুন করে মিথ্যার দরকার পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বরাবরের মতো পশ্চিমা এস্টাবলিশমেন্ট মিডিয়া সক্রিয় সহায়তা করছে। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে জিম্মিদের নিয়মিত বিনিময় ব্যবহার করে নৈতিক উচ্চ ভূমি দখল করতে হামাস ও ইসরায়েল উভয় পক্ষ একটি অনুমানযোগ্য প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের কাছে আবার সব ধরনের কার্ড আছে। তবুও পাথরের মতো কঠিন পশ্চিমা সমর্থন এবং জনসংযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা যুদ্ধে জয়ী হতে ব্যর্থ হচ্ছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি হামাসকে দায়ী করে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তিকে ‘অপমানজনক’ ও ‘নিন্দনীয় অনুষ্ঠান’ বলেছে। বিবিসিসহ পশ্চিমা মিডিয়া ইসরায়েলকে প্রতিধ্বনিত করে বলেছে, ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ১৩০ জনের হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলিদের নরহত্যার চেয়ে গুরুতর আইনি লঙ্ঘন ছিল। মিডিয়া একইভাবে দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের নতুন পদক্ষেপকে হালকাভাবে তুলে ধরেছে। হাজার হাজার বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে; পুরো সম্প্রদায়কে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া পরিসরগুলো লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে, এই যুদ্ধাপরাধও যুদ্ধবিরতি চুক্তির চরম লঙ্ঘন।

এখন নেতানিয়াহু পরের সপ্তাহে দ্বিতীয় পর্ব শুরু করার আগে নতুন চক্রান্ত হাতে নিয়েছেন। যুদ্ধবিরতি উড়িয়ে দেয়ার অজুহাত হিসেবে ইসরায়েলি বন্দি ও হামাসের মধ্যে আপাত স্বস্তিদায়ক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছেন। যখনই ইসরায়েল গাজা থেকে নিজেদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেবে এবং এর পুনর্গঠনের অনুমতি দেবে তখনই দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইসরায়েলি বন্দিরা নেতানিয়াহু ও তার সংকীর্ণমনা ক্ষমাপ্রার্থীদের জন্য কেবল তখনই উপযোগী, যখন তারা গণহত্যাকে ন্যায়সংগত করে এমন বয়ান তৈরি করতে সহায়তা করে। ট্রাম্পের কাছে কোণঠাসা হয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নির্বিচারে গাজার শিশুদের পুনরায় হত্যা শুরুর আগে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় আসতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত কিছু ব্যাপার তুলে আনতে গিয়ে তাকে মূল্য দিতে হয়েছিল, যাতে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তার নিজের জনসাধারণকে শান্ত রাখা যায়।

তিনি বারবার স্পষ্ট করেছেন, প্রথম পর্যায়ে প্রধান জিম্মি বিনিময়ের পর স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে অগ্রসর হওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। নেতানিয়াহুর ক্ষেত্রে ইসরায়েলি বন্দিদের গুরুত্ব শুধু গণহত্যার পথ উন্মোচন করা। অন্যদিকে হামাসের কাছে বন্দিদের মুক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র পথটি ব্যবহার করার সব প্রণোদনা রয়েছে। এতে বোঝানো যায়, এটি ইসরায়েলি-প্রকৌশলী ও পশ্চিমা প্রবর্তিত মতবাদ দ্বারা ভীতিগ্রস্ত নয়। এতে আশা করা যায়, তারা ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব সত্ত্বেও এখনও গাজার দায়িত্বে কতটা বহাল।

হামাসের ইসরায়েলি বন্দিদের সঙ্গে যুক্তিসংগত সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণ রয়েছে। অন্তত বিদেশি জনসাধারণের কাছে তার ভাবমূর্তি নরম করার জন্য নয়, বরং নেতানিয়াহু দ্বারা পুনরায় গণহত্যা চালানো কঠিন করে তোলার জন্য। ইসরায়েলের অবশ্য এমন কোনো পারস্পরিক প্রণোদনা নেই। তারা যতটা শক্তিশালী, যেটি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগেও ১৭ বছরের ছিটমহল অবরোধের মাধ্যমে গাজার সব মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল। এটি পছন্দমতো স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে পারে। দেশটি এমন জ্ঞানও উৎপাদন করতে পারে, পশ্চিমা মিডিয়া যা নিয়ে কখনও প্রশ্ন তুলবে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের কাছে মুক্ত ফিলিস্তিনি বন্দিরা তাদের নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের যেসব সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা কেবল উপেক্ষা করা হয়েছে।

ইসরায়েলের পক্ষে বিভিন্ন অবস্থান থাকা সত্ত্বেও পার্থক্যমূলক বাস্তবতা এতটাই তীব্র যে, ইসরায়েল তবুও প্রচার যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। এ কারণেই নেতানিয়াহু তার প্রয়োজনের চেয়ে এক দিন বেশি বন্দি বিনিময় চালিয়ে যেতে আগ্রহী নয়। সমস্যা হলো, হামাসের মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি বেশিরভাগই তার উদ্দেশ্যে কাজ করছে না। এতে তারা বাধা দিচ্ছে।

ইসরায়েলপন্থি গোষ্ঠীর মধ্যে যারা গাজার শিশুদের হত্যায় যুক্তি খুঁজে পান, তারা অবশ্যম্ভাবীভাবে তৎক্ষণাৎ রাগ ঢেলে দেয়ার মতো কাজ করছেন। আর বিবিসির ভূমিকা গুহা থেকে বিষয়টি উদোম করতে খানিক ধাক্কা দেয়ার মতো।

ইসরায়েলপন্থি লবি গোষ্ঠীগুলো যা ভয় পায় তা হলো, ফিলিস্তিনিদের কোনো প্রতিকৃতি, যা ইসরায়েলি প্রচারের বিরোধিতা করে। যেমন গাজার প্রত্যেক ব্যক্তি, এমনকি শিশুরাও সহিংস; যারা মৃত্যু ও ধ্বংস তাদের নিজের মাথায় নিয়ে এসেছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যার দ্বিতীয় ধাপ বা সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানালে, এই সংঘাতের মূল কারণগুলি অনেক পুরানো এবং বহুবিধ রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ। ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যেখানে ভূমি অধিকার, স্বাধীনতার দাবি এবং জাতিগত পরিচয় বিষয়ক সংঘর্ষ প্রবল রয়েছে।

ইসরায়েলি আক্রমণ এবং ফিলিস্তিনিদের অবস্থা: ২০১৪ সালের গাজার যুদ্ধের পর থেকে, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান চলতে থাকে। তবে, ২০২১ সালের মে মাসে যে যুদ্ধটি শুরু হয়, তা ছিল ব্যাপক আক্রমণাত্মক এবং প্রভাবশালী। ২০২১ সালে গাজা শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা, স্থল বাহিনীর অভিযান এবং রকেট হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং আহত হন, বিশেষ করে বেসামরিক জনগণের মধ্যে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

২০২৩-২০২৪ সালের পরিস্থিতি : ২০২৩ সালের পর থেকে গাজার পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ২০২৪ সালে ইসরায়েলি বাহিনী আবারও গাজা অঞ্চলে বিমান হামলা শুরু করে এবং সেখানে প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। সেসময়, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনগুলো, বিশেষ করে হামাস, ইসরায়েলের দিকে রকেট ছুঁড়তে থাকে, যা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, কারণ এটি জাতিগত দমনপীড়নের মধ্যে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের আকার ধারণ করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং মানবাধিকার : গণহত্যার অভিযোগের পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই সংঘাতের প্রতি প্রতিক্রিয়া বিভক্ত। কিছু দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করলেও, অনেক পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তবে পরিস্থিতির কোনো স্থায়ী সমাধান এখনও পাওয়া যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এবং মানবাধিকার সংস্থা একাধিকবার সতর্ক করেছে যে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে ধরনের দমনপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটছে, তা আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তির পরিপন্থি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত