প্রকৃতির অপরূপ দান পর্বত। পার্বত্য অঞ্চলের পর্বতের সুরক্ষায় নির্ভর করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা। পৃথিবীর প্রায় ২২ শতাংশই পার্বত্য অঞ্চল। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবন অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। পর্বতমালা, নদ-নদী, বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী এ অঞ্চলকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। পর্বত আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশের বাস পর্বতে। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ হটস্পট এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহকারী উৎস বলা হয় পর্বতকে। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের এক চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি প্রায় ২৭ শতাংশ জায়গাজুড়ে আছে বিস্তৃত পর্বতরাশি। এ পর্বতরাশি থেকে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন পৃথিবীর ২২ শতাংশ মানুষ। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যুগের পর যুগ পর্বত হতে আহরিত সম্পদ দ্বারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছে। সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলে শীতকালে তুষার পড়ার হার গ্রীষ্মে গলনের হারের চেয়ে বেশি হলে পাহাড়ের উপরে তুষার জমতে শুরু করে এবং জমে শক্ত বরফে পরিণত হয়। এই বরফজমা এলাকাটিকে বরফক্ষেত্র বলে। যখন এই জমা বরফ নিজের ওজনের ভারে এবং মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরগতিতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে, তখন তাকে হিমবাহ বলে। হিমবাহ মানে তুষারের নদী। তুষার হলো হালকা বরফ যা গ্রীষ্মকালেও সেভাবে গলে না। তুষারের নদী চিরকাল টিকে থাকে। বিশ্বের যে কোনো পাহাড়ের গায়েই হিমবাহ থাকতে পারে। যেমন আল্পস পর্বতে রয়েছে প্রায় ১২শ’ হিমবাহ। তুষারধস হিমবাহ হয় কোনো নদীকে স্রোতস্বিনী করে তোলে নতুবা নিচের কিছুটা উত্তপ্ত আবহাওয়ায় গলে গিয়ে নিজেই ছোটখাটো নতুন নদীতে পরিণত হয়। আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামার পথ যদি অজানা হয় তাহলে নামার পথে হিমবাহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। একে পর্বতারোহীদের ভাষায় বলে অ্যাভালাঞ্চ। বিভিন্ন সাগর-মহাসাগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা আকারের প্রকাণ্ড সব হিমবাহ। এছাড়া দুই মেরুতে আছে হিমবাহ। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে জ্যাকবশাভ্যন নামের হিমবাহের বিশাল এক অংশ ঘুরছিল গ্রিনল্যান্ডের আশপাশের আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে। সেই হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় টাইটানিক নামের সেই সময়কার সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রায় সব হিমবাহ দ্রুত গতিতে গলছে। বরফ গলে যাওয়ার কারণে বিশুদ্ধ পানি সমুদ্রের লবণ পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ফলে মিঠা পানি হ্রাস পাচ্ছে। বরফ বিলীন হওয়ার অর্থ হলো এর উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য জলের অভাব এবং হিমবাহ-প্রতিষ্ঠিত বাস্তুতন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে উদ্ভিদ এবং মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির আবাসস্থলের জন্য হুমকি। হিমবাহ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করার জন্য ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দকে হিমবাহ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক বছর হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ২১শে মার্চকে বিশ্ব হিমবাহ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক বর্ষ এবং বিশ্ব হিমবাহ দিবসের লক্ষ্য জলবায়ু ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ চক্রে হিমবাহ, তুষার এবং বরফের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং পৃথিবীর ক্রায়োস্ফিয়ারে আসন্ন পরিবর্তনের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সেইসঙ্গে এই বিষয়ে সর্বোত্তম অনুশীলন এবং জ্ঞান ভাগ করে নেয়া এবং হিমবাহের দ্রুত গলে যাওয়া এবং এর পরিণতি সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা। মনে হতে পারে বাংলাদেশে সুউচ্চ পর্বতমালা নেই। তার ওপর আমাদের দেশ মেরু অঞ্চল থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখা দরকার ভৌগোলিকভাবে আমাদের অবস্থান উপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন। দেশটির ৪৩ লাখ জনগোষ্ঠী ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত লাইফ অ্যাডাপ্টেড প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে, ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৩২ মিলিয়ন এবং ভারতের ২৭ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকিতে থাকবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য এরইমধ্যে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পাঁচটি সবুজ প্রবাল দ্বীপ ডুবে গেছে। ২১০০ সালের মধ্যে কোনো দেশ নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে না থাকলেও বড় বড় বেশ কিছু শহর প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা উল্লেখযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা অন্যতম। বাংলাদেশের জন্য হিমবাহ গলনের সমস্যা কেবল বৈশ্বিক পরিবেশগত ইস্যুই নয়, ইহা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও এক বিরাট হুমকি। সত্যিকার অর্থে হিমবাহর গলনে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ কমবেশি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে হিমবাহ গলার হার বাড়তে শুরু করে। পৃথিবীর তাপমাত্রা যতোই বাড়ছে, এর মেরুগুলোর চারপাশের সমুদ্রের হিমবাহও ক্রমেই গলে যাচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকার ফ্লোরিডায় ৮০ মাইল প্রস্থের পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশস্ত হিমবাহ থোয়েইটস গ্লেসিয়ার বা কেয়ামতের হিমবাহ তার আকার হারাচ্ছে এবং দ্রুত গলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন হিমবাহের এ দ্রুত পরিবর্তিত অবস্থার কারণে মহাসাগরগুলোতে পানির স্তরের অতিরিক্ত বৃদ্ধি বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে। নেচার জার্নালে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকার দৈত্যাকার থোয়াইটস হিমবাহের দুর্বল অংশগুলোতে গরম পানি প্রবেশ করছে। পাশাপাশি ক্রমশ বাড়তে থাকা তাপমাত্রায় হিমবাহের গলে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আগামী শতাব্দীর মধ্যে হিমালয়ের ৭৫ শতাংশ বিলীন হয়ে যেতে পারে। ফলে পরিবেশের এমন ক্ষতি হবে যা অপূরণীয়। হিমবাহ না থাকলে পৃথিবীতে এত তাপ বাড়বে যে তা কল্পনা করাই কঠিন। বিপর্যস্ত হবে জনজীবন। সংকটে পড়বে প্রাণীকুল। গবেষকদের মতে, আগামী দশকের মধ্য ও পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের অধিকাংশ হিমবাহ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যে কারণে আসন্ন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনেক দেশ। নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫ মিলিয়ন মানুষ হিমবাহ হ্রদে ক্রমবর্ধমান বন্যার হুমকির মধ্যে রয়েছে। যদি এই হিমবাহগুলো গলে যায়, তাহলে পানি এসে মিশবে হ্রদে। ফলে হ্রদ প্রবাহিত হবে এবং তারপর হ্রদের পাড় ভেঙে যাবে। এমতাবস্থায় লেক থেকে পানি বের হতে থাকবে। ফলে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হবে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এবং এর বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) আবহাওয়া, জলবায়ু এবং জল সংস্থা, ২,৭৫,০০০ হিমবাহ উদ্ধারের প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য একটি আবেদন শুরু করেছে যা বিশ্বব্যাপী দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষকে মিষ্টি জল সরবরাহ করে। আন্তর্জাতিক হিমবাহ সংরক্ষণ বর্ষ শুরু করার প্রারম্ভিক কালে সংস্থাগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করণে জরুরি এবং টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। আমাদের মাথায় রাখা দরকার হিমবাহগুলো পানীয় জল, কৃষি এবং জলবিদ্যুতের পাশাপাশি আমাদের নদীগুলোকে ঠান্ডা রাখার জন্য এবং সেখানে বসবাসকারী উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের সাথে আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে বন্ধুত্বপূর্ণ রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিমবাহের বরফের ক্ষতি মানবসৃষ্ট উষ্ণায়নের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই উষ্ণায়নের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, মিথেন নির্গমন এবং খাদ্য অপচয়। অপ্রিয় হলেও সত্য আমরা প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে উষ্ণায়নের এই কারণগুলোর সঙ্গে জড়িত। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিমবাহ গলে যাওয়ার গতি গত দুই দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পৌঁছেছে। উরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) মতে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ শিল্পপূর্ব যুগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যা ছিল, তার তুলনায় ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে হিমবাহ স্থানগুলো থেকে এক তৃতীয়াংশ বরফ অদৃশ্য হয়ে যাবে। প্রাগৈতিহাসিক কালের ধ্বংসাবশেষ যেমন: বিলুপ্ত ম্যামথ এবং পশমী গণ্ডার থেকে শুরু করে প্রাচীন উদ্ভিদ এবং ব্যাকটেরিয়া আরও অনেক কিছু হিমবাহের হিমায়িত মাটির নিচে বরফের নিম্ন তাপমাত্রার কারণে হাজার হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত রয়েছে সেগুলো উন্মুক্ত হয়ে যাবে। প্রাগৈতিহাসিক কালের জীবাশ্মের ধ্বংসাবশেষে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন রয়েছে। একবার সেগুলো উন্মুক্ত হয়ে গেলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বর্তমান ঘনত্বকে বাড়িয়ে তুলবে, যার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা আরও বেড়ে যাবে। তাই আমাদের হিমবাহ সংরক্ষণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অন্যথায়, হিমবাহ গলে যাওয়ায় পৃথিবী এমন এক অবস্থায় চলে যাবে যেখান থেকে পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে একযোগে সচেতন হতে হবে এবং হিমবাহ সংরক্ষণে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা এক ভয়ংকর পৃথিবী রচনা করতে যাচ্ছি।
লেখক : প্রভাষক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।