বাবার যদি কাড়িকাড়ি টাকা, গাড়ি-বাড়ি না থাকে, তবে পড়াশোনাটা ঠিকঠাক মতো করো। যদি অনেক সম্পদ থাকে, তবে সেটা ঠিকমতো ব্যবহার করতে শেখার জন্যও পড়াশোনা করা দরকার। সম্মান যদি পেতে চাও কিংবা পারিবারিক সম্মান সমাজে বহাল রাখতে চাও, তবে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ভাগ্য বদল এবং উন্নয়নের একমাত্র চাবিকাঠি পড়াশোনা। উচ্চবিত্তের মানবিকতা শেখা এবং মানুষ হওয়ার গতিপথও নির্ধারণ করে পড়াশোনাই। পয়সা আছে, অথচ পড়াশোনা নেই- এদের মতো অথর্ব সমাজে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। পয়সাও নেই এবং পড়াশোনাও নেই- এদের মতো অসহায় সমাজে অল্পই মেলে। পয়সা নেই, অথচ পড়াশোনাটা ঠিকঠাক আছে-জীবনযুদ্ধে এরা আটকায় না। স্বপ্নই তাদের পথ দেখায়। সমাজ যদি সুস্থ হয়, তবে পড়াশোনা জানা ব্যক্তিরাই সেখানে সম্মানিত হবেন। মানসিক দীনতা এবং সামাজিক অবহেলা দূরীকরণে জ্ঞানের দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। তবে জ্ঞান কেবল বই থেকেই সঞ্চিত হবে এমনটাও নয়। দক্ষতার সংজ্ঞা বহুবিধ ও বহুমাত্রিক হতে পারে। তবে বিপন্ন পরিবারকে এবং গরিব-অসহায় মানুষকে পড়াশোনা এমনভাবে মূল্যায়িত করেছে, যাতে তারা সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আর্থিক স্বাবলম্বিতা ও সম্মান পেয়েছে। আত্মপরিচয়ের গ্লানি বিমোচনে পড়াশোনাই হতে পারে একমাত্র বিকল্প। যে শিক্ষার্থী শৈশব থেকেই অধ্যবসায়ী ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, পড়াশোনার শক্তি তাদের প্রতিষ্ঠিত করার আগে ক্লান্ত হয়নি। পৃথিবীতে যারা বিখ্যাত, শত-সহস্র বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও আজও যারা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ও সম্মানপ্রাপ্ত, তাদের প্রত্যেকের অস্ত্র ছিল পড়াশোনা। তাদের সাফল্যের সিঁড়ি নির্মিত হয়েছে অধ্যয়নের জ্ঞানে। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রজন্ম পড়াশোনার অসংখ্য ভুল বিকল্প বের করেছে। সবকিছুর পরিণতি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সম্পদ ও ক্ষমতাকে। শর্টকাটে সফল হওয়ার কুমন্ত্রণা দিয়ে একদল প্রজন্মকে বিপথে নিচ্ছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভ্রষ্ট রাজনৈতিক চর্চা শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় ভুলে জড়িয়েছে। শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা এ ব্যাপারে একমত হবেন যে, শিক্ষার্থীদের দিয়ে আজকাল সব কাজ করানো যায়, কেবল পড়াশোনা ছাড়া। ক্লাসে যারা ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত, তাদের সঙ্গে আলাপ করেও জানা গেছে- তাদের পড়াশোনার ব্যাপ্তি কেবল পাঠ্যবইয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ। পাঠ্যবই তো একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে থামিয়ে দেবে, কেননা শ্রেণি-পাঠ্যের সীমাবদ্ধতা সাংঘাতিক। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ক্ষমতাকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাংয়ের অংশ হয়ে গেছে। বাকিদের সঙ্গী মোবাইল, টিকটক ও অনলাইন-অফলাইনের বাজে আড্ডা। হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন-দুইজন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলে সেটাকে সার্বিক সাফল্য বলা চলে না। অতীতের সোনালি প্রজন্মের সহপাঠীদের অধিকাংশই সফল। তরমুজ পচে গেলে সেটার দুর্গন্ধ তৎক্ষণাৎ টের পাওয়া যায়। কিন্তু প্রজন্ম ভুল পথে চললে, সেটার ভুক্তভোগী হতে দশক অপেক্ষা করতে হয়। আমরা সেই শূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দশক পর দুর্দিনের সূর্য ভয়ংকরভাবে আঘাত হানবে। গ্রাম-শহরের লাইব্রেরিগুলোতে খোঁজ নিলেই বাস্তবতা উঠে আসবে। পাঠক নেই, ক্রেতাও নেই। এমনকি গ্রন্থাগারগুলোতে দর্শনার্থী পর্যন্ত নেই! তালাবদ্ধ রুমে ধুলোর স্তর পুরুত্বে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রজন্ম তো কোথাও না কোথাও সময় কাটাচ্ছে। যদি গ্রন্থাগারে না যায়, তবে নিশ্চয়ই খেলার মাঠে আছে? না, সেখানেও নেই। তারা মোবাইল গেমে ব্যস্ত। বদ্ধ রুমে মনিটরের সামনে দিন-রাতের পার্থক্য একাকার করে ফেলছে। কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডায় লিপ্ত। তারাবিহের সময় শহর ঘুরে দেখেছি- বাসা থেকে নামাজের কথা বলে বের হয়ে আসা প্রজন্মের বিপুল অংশ এখানে-ওখানে মোবাইলকেন্দ্রিক আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য, টিনএজারদের অধিকাংশের ওপর বাবা-মায়ের পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নেই। এসবের খেসারত দিতে হবে না? শুধু মা-বাবাকেই দুর্দিন পোহাতে হবে? না, সমগ্র জাতিকেই কালের দুর্বিপাকে পড়তে হবে। সংস্কার করা, দেশকে সুন্দর করা- রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত এই সব আয়োজনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে, যদি প্রজন্ম সুপথে না হাঁটে। প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমের মনোভাব, নৈতিকতাবোধ ও দায়িত্বশীলতা যদি জাগ্রত না হয়, তবে আমাদের আশাহীন হতে হবে। রাষ্ট্র পথ সৃষ্টি করে রেখে যেতে পারে, কিন্তু সেই পথ ব্যবহারের যোগ্য ও দক্ষ পথিকও তো গড়ে তুলতে হবে। কাজেই মানুষ গড়ার প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
পড়াশোনাটা ঠিকঠাকভাবে তত্ত্বাবধান করতে হবে। শতভাগ শিক্ষার্থীকে পাঠাভ্যাসে ফিরিয়ে আনতে হবে। রাষ্ট্রের এই সেক্টরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এখানে সুষম বিনিয়োগ করতে হবে। প্রজন্মের পাঠাভ্যাস ঠিক হয়ে গেলে, সব বদভ্যাস আপনা-আপনি দূরীভূত হবে। তখন শিশু-কিশোরকেন্দ্রিক অপরাধও কমে যাবে।