সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অসীম নিয়ামতের ভান্ডারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামত পানি। পৃথিবীর প্রধানতম একটি সম্পদ এই সর্বজনীন দ্রাবক পানি। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশই পানি তবুও বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির সংকট সমগ্র বিশ্বজুড়ে। সুপেয় পানির এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পানি দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘সুপেয় পানির জন্য হিমবাহ সংরক্ষণ করি’। হিমবাহ রক্ষার উপর জোর দেয়ার কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পার্বত্য ও মেরু অঞ্চলের হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়ায় সুপেয় পানির প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈরী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। এ বছরটা বাংলাদেশের ইতিহাসে উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
ভয়াবহ বন্যায় ভেসেছে দেশ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত বছরের এপ্রিলে তাপমাত্রা ছিল ৭৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহ চলে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার বিপদ সামনের দিনে আরও বাড়তে পারে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) বুধবার (১৯ মার্চ) প্রকাশিত ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ক্লাইমেট রিপোর্ট’-এ উদ্বেগজনক এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। গত ২১ মার্চ বিশ্ব হিমবাহ দিবস আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস এবং আগামীকাল ২৩ মার্চ বিশ্ব আবহাওয়া দিবস সামনে রেখে প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়। বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থাটি বলছে, চরম আবহাওয়াজনিত কারণে ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেকর্ড ক্ষয়ক্ষতির বছর। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর। অতি গরম ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়, টাইফুনসহ নানা কারণে গত ১৬ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক এবং স্থানীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পানি দিবসের ধারণাটি প্রথম ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘের সম্মেলনে প্রস্তাবিত হয়। পরবর্তীতে একই সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রতিবছর ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে মনোনীত করে একটি প্রস্তাব পাস করে। এরপর ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের সদস্যদেশ হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন উপলক্ষে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পানি ছাড়া জীবনধারণ অসম্ভব। জন্মের পর থেকে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য আমরা নানাভাবেই পানির ওপর নির্ভরশীল।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে পানি এবং টেকসই উন্নয়ন একে-অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পানি ছাড়া যেমন- আমাদের জীবন অচল ঠিক তেমনি জলবায়ু ও প্রকৃতি, যা আমাদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্যও পানি অপরিহার্য। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি। ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য যা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ দেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে সুপেয় পানির অভাবে। দেশের উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওড়াঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বদ্বীপ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ পানির সংকটে পড়েছে দেশ। বিশুদ্ধ বা সুপেয় পানির অভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নদী ও পানির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে সুপেয় পানি পাচ্ছে না প্রায় ৩ কোটি মানুষ।
২০৩০ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা বাড়বে ৪০ শতাংশ। এখন যে পরিমাণ পানি আছে, তাতেই আমাদের প্রচণ্ড হাহাকার। ফলে নতুন করে সুপেয় পানি কোথা থেকে আসবে, তা কেউ জানে না। আগামী দশকেই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনে বিশুদ্ধ বা সুপেয় পানির অভাবে বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে। বেশিমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে পানির। লোনা পানির আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিদ্যমান পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আর পানির অপচয় রোধ করেই আমাদের এগোতে হবে।বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তবতায় বিশ্বের সঙ্গে মিলেমিশে সুপেয় পানি সংরক্ষণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। নচেৎ পানি সংকটের কারণে আগামীতে পৃথিবীতে সংঘর্ষ ও অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। সুপেয় বিশুদ্ধ পানি না পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ পানি দূষণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন পানিদূষণ ঘটছে। শিল্প থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক গিয়ে পড়ছে পানির মধ্যে। কৃষিজমি থেকে আসা কীটনাশক বর্জ্যের কারনেও পানিদূষণ ঘটছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস, পয়োনিষ্কাশনসহ নতুন নতুন দূষণকারী বস্তু পানির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ বর্জ্য পানি কোনো রকম বিশুদ্ধকরণ ছাড়াই জলাশয়ে গিয়ে পড়ছে। পানির দেশ বাংলাদেশ এখন পানিসংকটে ভুগছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে দেশের অনেক জায়গায় পানিস্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। দূষণের কারণে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির গুনগত মানও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পানি দূষণ ঠেকাতে পয়ো-আবর্জনা, শিল্পের আবর্জনা, কঠিন আর্বজনা, কীটনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, এসিড, খনিজ তেল বিশেষ করে মলমূত্রের বর্জ্য কোনোভাবেই যেন সরাসরি প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলোতে মিশে না যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশে পানিসংক্রান্ত যে আইন ও বিধিগুলো (বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩; কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১৮; পানি বিধিমালা, ২০১৮ ইত্যাদি) আছে, তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। দেশের উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওড়াঞ্চল, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে নিত্যদিন মানুষ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শহরাঞ্চলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা ট্যাপের ৮০ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু ই-কোলাই রয়েছে। শুধু দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে যার অধিকাংশই শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাওয়ার পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার ৩২ বছর পরও বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এখনো আর্সেনিকে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।
দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার। ফলশ্রুতিতে দেশের অনেক এলাকায় সুপেয় খাবার পানি এখন দুষ্প্রাপ্য। যা নলকূপনির্ভরতা বাড়িয়ে তুলছে ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। খোদ রাজধানী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির উৎস প্রায় শেষের পথে। প্রতিবছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার নেমে যাচ্ছে। যে কারণে অনেক গভীর নলকূপে পানি আসছে না। অনেক নলকূপের কমছে উৎপাদন ক্ষমতা। আশঙ্কা করা হচ্ছে এতে করে সুপেয় পানি প্রাপ্তিতে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে ঢাকা মহানগরী। উপরন্তু আমাদের দেশে পানি ও স্যানিটেশনে বৈষম্য একটি বড় বিষয়। শহরের অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী মানুষ যতটা পানি ব্যবহার করে থাকে; বস্তিবাসী ততটা পারে না। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- উপকূলীয় এলাকার মানুষ, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপর্যস্ত, তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য পানি কিনতে হয়। জীবন ধারনের অন্যতম একটি উপাদান পানি তাই এই বৈষম্যদূরীকরণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি; কিন্তু এখনো আমাদের সুপেয় পানির অভাব, পানির মধ্যে রোগ-জীবাণু যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ব পানি দিবসে একটাই প্রত্যাশা জনগণের সুপেয় পানি প্রাপ্তিকে রাষ্ট্রের সরকার সর্বাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দিবে।
লেখক : প্রভাষক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ
নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।