শান্তির ধর্ম ইসলাম আর তার মহাগ্রন্থ আল কোরআন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে একমাত্র (গ্রহণযোগ্য) ব্যবস্থা। ইসলামি জীবন ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা বা complete code of life বলা হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন, ‘ইন্নাদ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম’ (সূরা আল্-ইমরান, আয়াত-২৯)। ইসলামি জীবনের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি জাকাত। পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে জাকাত এবং হজ হলো- আর্থিক শর্তসাপেক্ষ ফরজ ইবাদত। হজের ক্ষেত্রে সামর্থ্য থাকলে মুসলমানরা অর্থ ব্যয় করে হজ আদায় করবেন। কিন্ত জাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলে তা থেকে একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে অর্থ-সম্পদ আটটি খাতে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক। যে খাতগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে ৩২ বার জাকাতের কথা বলা হয়েছে। ‘সালাত’ শব্দের পাশাপাশি ‘জাকাত’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা প্রকৃতপক্ষে জাকাতের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। সূরাহ বাকারা’র ৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন ‘আর (তোমরা) নামাজ কায়েম কর ও জাকাত আদায় কর’।
সূরাহ বাকারা’র ২৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা প্রচুর সম্পদ দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা (তার) রিজিক সংকুচিত করে দেন’। সূরাহ আয-যারিয়াত’র ১৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তাদের সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’। আবার সূরাহ তাওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ‘(হে নবী) আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকাহ (জাকাত) গ্রহণ করুন এবং এর দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন’।
উদ্ধৃত আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে এটি সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় যে, মহান আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে সম্পদের তারতম্য করেছেন এবং একই সাথে অধিক সম্পদধারীদের সম্পদে দরিদ্রদের হক বা অধিকারকে অত্যাবশ্যকীয় বা ফরজ আকারে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রকারান্তরে এটিও ঘোষণা করেছেন যে, যাকাত আদায় না করলে সম্পদ পবিত্র এবং পরিশোধিত হবে না। সুরাহ আল-মুমিনুন এর চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ তাআলা পূর্ণ মু’মিনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘যারা জাকাত দানে সক্রিয়’।
জাকাত ইসলামি অর্থনীতির এমন একটি অনুসঙ্গ যা সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচন, সম্পদের সুষম বণ্টন, ভাতৃত্ব দৃঢ়করণ, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরাসরি কার্যকর। ইসলামে জাকাতের খাতভিত্তিক হার নির্ধারণ, বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। সূরা আৎ-তাওবাহ (আয়াত-৩৪) এবং সূরা আন-আম (আয়াত-১৪১) এ আল্লাহ পাক যেসব সম্পদের জন্য জাকাত আদায় করতে হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের বাণী এবং রাসুল (সা.)-এর হাদিসগুলো পর্যালোচনা করে ইসলামি চিন্তাবিদ, মুফতি মুহাদ্দিসগণ নিম্নরূপ নিসাব (জাকাতযোগ্য সম্পদ) সম্পর্কে একমত পোষণ করেছেন এরূপ পাঁচটি সম্পদের নিসাব পরিমাণ হলো- (১) স্বর্ণ: ৮৫ গ্রাম বা সাড়ে ৭ ভরি (২) রৌপ্য: সাড়ে ৫২ তোলা (২০০ দিরহাম সমান ৫৯৫ গ্রাম) (৩) নগদ অর্থ: সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (৪) পশু: পাঁচটি উট অথবা ৩০টি মহিষ-গরু অথবা ৪০টি দুম্বা-ছাগল-ভেড়া (৫) ফসল : ২৪ মতান্তরে ২৬ মণ (পাঁচ ওয়াসক)। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু সম্পদের উপর জাকাত আদায়যোগ্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন- মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়ায় জাকাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উল্লেখ্য উক্ত আইনে বাংলাদেশে জাকাত বাধ্যমূলক করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে জাকাতের প্রকৃত হিসাব নির্ধারণ, জাকাত আদায় এবং শরীয়াহ মোতাবেক প্রকৃত হকদারদের মধ্যে বিতরণের কার্যক্রমটি সম্পূর্ণ ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা ও পছন্দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আবার কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এতিমখানা, কওমী মাদরাসা জাকাত আদায় ও বিতরণ করে থাকে। বিদ্যমান অবস্থায় সরকারের পক্ষে জাকাত আদায় ও বিতরণের প্রকৃত হিসাব সংরক্ষণ অসম্ভব।
আমাদের দেশে জাকাতের সিংহভাগ জমা হয় কওমী মাদরাসা ও এতিমখানাসমূহে। জাকাত বিতরণ বা জাকাতের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে জাকাত বোর্ডের ওপর মানুষের খুব একটা আস্থা নেই। অনেকেই আবার ঘোষণা দিয়ে জাকাতের নামে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের মতো দৃষ্টিকটু কাজ করছে! যদিও আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা আত-তাওবার আয়াত: ৬০ এ সুস্পষ্টভাকে জাকাতের হকদার আটটি খাতের কথা উল্লেখ করেছেন। খাতগুলো হলো- ফকীর, মিসকিন, জাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী (আমিলীন), অমুসলিমদের) অন্তর জয় করার জন্য, দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় (বা ফি সাবিলিল্লাহ) এবং মুসাফিরদের মধ্যে। অথচ অনেকেই এ খাতগুলোর বাইরে এসে এবং জাকাত গ্রহীতার চাহিদা বিবেচনা না করে জাকাতের অর্থ ব্যয় করছেন। ফলে একদিকে যেমন যথাযথভাবে ফরজ আদায় হচ্ছে- না অন্যদিকে তেমনি সামগ্রিক অর্থনীতিতে ও দারিদ্র্যদূরীকরণে জাকাতের প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে না। যা জাকাতের মূল চেতনার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
জাকাত যেমন ইসলামের একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত, আয়কর তেমনই রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটির কারণে অপরটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বরং বাংলাদেশে এ দু’টির মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে আয়কর হিসেবে নগদ বা ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি করমুক্ত সম্পদ। তাই অনেকে কর ফাঁকি দেয়ার ইচ্ছায় করযোগ্য সম্পদকে এসব সম্পদে রূপান্তর, সংরক্ষণ ও আয়কর হিসাবে প্রদর্শন করেন। আবার অনেকে অর্জিত না হওয়া সত্ত্বেও করমুক্ত এসব খাতে বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সোনাদানা প্রদর্শন করে থাকেন। আয়করের সাথে জাকাতের সংযোগ স্থাপন করা গেলে এ প্রবণতা দূরীভূত করা সম্ভব। কারণ এসব সম্পদ আয়করমূক্ত হলেও জাকাতযোগ্য।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪ : সংঘাতের মধ্যে দারিদ্র্য’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক পাঁচ শতাংশের অবস্থা গুরুতর। এ বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জাকাতের আওতায় এনে বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। জাকাতে আওতাভুক্ত সবার কাছ থেকে উপযুক্ত পরিমাণে জাকাত আদায় করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে ঠিক কী পরিমাণে জাকাত আদায় হতে পারে এ বিষয়ে খুব নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এম. কবীর হাসানের নেতৃত্বে একদল গবেষক ২০০৫ এবং ২০২২ সালে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎসসম্পদ, জিপিএফ-পেনশন, ব্যবসা, ব্যাংকে জমা, শেয়ার-বন্ড ইত্যাদি খাতের সেকেন্ডারি তথ্য ব্যবহার করে দু’টি সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেন। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০১ সালে দেশে আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ ছিলো ৮০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা) এবং ২০২১ সালে ২ হাজার ৪২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান এ বিপুল পরিমাণ জাকাতের অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে দেশে একজন দরিদ্র মানুষও এদেশে খুঁজে কঠিন হবে। ইসলামি শাসন ব্যবস্থায় খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে হযরত আবু বকর (রা.) জাকাত আদায় ও বিতরণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিলেন বলেই হয়তো হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে জাকাতের সম্পদ বিতরণের উপযুক্ত ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কবি ও কলাম লেখক।