অনেক শিক্ষিত, জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিমান লোককে বলতে শুনি, বয়স কোনো ব্যাপার না- বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। কেউ কেউ সক্ষমতা বোঝাতে বলে, আমি এখনো দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করি। বয়সকে পাত্তা না দেয়ার লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মানুষ নিজেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সক্রিয় এবং কর্মঠ হিসেবে ভাবতেই অনেক পছন্দ করে। এধরনের চিন্তা ভাবনা খারাপ কিছু না। যারা বয়সকে সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করেন তারা মূলত : নিজেকে বাস্তবতার বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। নির্দিষ্ট একটা বয়সকে মানসিকভাবে ধারণ করা মানে বয়সবিদ্বেষী একটি মনোভাব পোষণ করা। জন্মের পর থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত শারীরিক বিকাশ হয়ে থাকে। ৪০ বছর বয়সের পর থেকে শরীর বৃত্তীয় পরিবর্তন শুরু হতে থাকে।
৫০ বছর বয়সে সেটি আরো বেশি নজরে আসতে থাকে এবং ৬০ বছর বয়স থেকে শরীর শিথিল হয়ে আসে।
সামাজিক বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত সকল মানুষের কল্যাণের জন্য অর্থ সমর্পণ বা সম্পত্তি অর্জন। সামাজিক বিনিয়োগ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন একটা সাড়া শব্দ শুনতে পাই না। সামাজিক বিনিয়োগের ধারণা, প্রচলন, চর্চা আমাদের সমাজে নানা ভাবে ছিল। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে একটা করে কুড়াল, খন্তা, শাবল, বড় কোদাল, হাতুড়ি থাকত। যার যখন দরকার হতো তিনি ব্যবহার করতে পারতেন। বাড়িতে বসবাসরত সকলে মিলে কাচারি ঘর বা বৈঠক খানা নির্মাণ করত এবং স?ংস্কার করার প্রয়োজন হলে সবাই মিলেমিশে তা করত। কাচারিতে বাড়ির লোকজন আড্ডা দিত, ছেলে মেয়েরা পড়তে যেতে, মেহমান মুসাফির রাত্রিযাপন করত, জরুরিভিত্তিতে ফসল তুলে রাখত, সালিশ বৈঠক হতো, জারি সারি, গান-বাজনা, কবি গান এবং পুঁথিপাঠ হতো। বাড়ির সবার এজমালী একটা জায়গা কিংবা ফলের বাগান থাকতো, যেখান থেকে প্রাপ্ত আয় এবং ফলমূল সবাই ভাগবাটোয়ারা করে নিত।
বাড়ির পুকুর, ঘাটলা, পায়খানা, উপসানালয়, ধর্মীয় স্থান, উঠোন সবাই মিলেমিশে ব্যবহার করত। একে অপরের বিপদে আপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিলেও স্বার্থের কারণে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হতো এবং দ্রুত মিটমাট হয়ে যেত। গ্রামীণ সমাজে মিলেমিশে এজমালী জায়গা জমি পথঘাট ব্যবহারের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখত। নিজেদের মধ্যের ঝগড়া বিবাদ স্থানীয়ভাবে আপোষ-মীমাংসা করে দেয়া হতো।
সামাজিক নানা রকমের পরিবর্তনের কারণে মানুষের মধ্যে এজমালী সম্পত্তি ব্যবহারের মন মানসিকতা নেই বললেই চলে। গ্রামের বাড়িতেও মানুষ শহরের আদলে বাড়ির উঠোনে দেয়াল তুলে উঠোন ব?্যবহার অনুপোযোগী করে রেখেছে। পুকুর ঘাটে কিংবা কাচারি বাড়িতে এখন আর জমজমাট আড্ডা হয় না বললেই চলে। যে যার মতো করে জীবনযাপন করছে। পড়শীর সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা মনে করে মন খারাপ করার লোকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
সামাজিক মালিকানার বদলে ব্যক্তি মালিকানার দাপট মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। আবার পুরোটাই সামাজিক মালিকানায় বহাল করতে চাইলে সমাজ উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়তে পারে। ফলে ব্যক্তিগত মালিকানার সাথে সামাজিক মালিকানার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। প্রবীণের সুরক্ষায় সামাজিক বিনিয়োগ কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে, সে বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা রাখতে চাই।
বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি প্রবীণের সিংহ ভাগই গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামের প্রবীণদের বড় অংশ দরিদ্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেঁচে থাকতে ছেলেমেয়েদের সহযোগিতা লাগে। অল্প কিছু সংখ্যক প্রবীণ আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসীর দয়া করুণার উপর ভর করে জীবন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালান।
শহরে বসবাসকারী অনেকেরই গ্রামের বাড়িতে ঘরবাড়ি রয়েছে। সেখানে কেউ বসবাস করে না। বাড়িঘর কেয়ার-টেকারের তত্ত্বাবধানে থাকে। এসব বাড়িঘর প্রবীণ কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা যায়। বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জগুলো সামাজিকভাবে মোকাবিলা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যদিও বার্ধক্য প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত অর্জন। প্রাথমিকভাবে বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জগুলো ব্যক্তিকেই মোকাবিলা করতে হয়। নানা কারণে ব্যক্তির পক্ষে একা বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যেক গ্রামে, ওয়ার্ডে, ইউনিয়নে প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএস?এফ) সারাদেশে সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে দুই শতাধিক প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। নানা রকমের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও গ্রামের সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। প্রবীণ সামাজিককেন্দ্র প্রবীণের অধিকার, বিনোদন, চিকিৎসা, সেবা, ফিজিওথেরাপি, সালিশ-মীমাংসা, তহবিল সংগ্রহ, দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্রকে সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গ্রাম, মহল্লা, পাড়াভিত্তিক প্রবীণদের সংঘবদ্ধ হয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে প্রবীণ কল্যাণে গড়ে উঠা প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্রগুলোকে স্বয়ং সম্পূর্ণভাবে সাজাতে হবে স্বাস্থ্যসেবার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার, সাকার মেশিন, মেডিক্যাল বেড, পালস্ অক্সিমিটার, থার্মোমিটার, ব্লাড প্রেসার মেশিন, গ্লুকোমিটার, ফিজিওথেরাপি সামগ্রীসহ জীবন রক্ষা কারী ওষুধপত্র। এক?ই ব্যবস্থা সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রাখা যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারের সাথে স্থানীয় প্রবীণদের মধ্যে একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র এলাকায় বসবাসরত সকল প্রবীণের নাম ঠিকানা, ফোন নাম্বার, নিকট জনের ফোন নাম্বার? সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতি মাসের মিটিং চলাকালীন সময়ে যেসব প্রবীণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রয়োজন মনে করলে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানোর দরকার হলে সেরকম ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দ্স্থু প্রবীণদের তালিকা করে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব প্রবীণ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দরকার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা নিতে হবে। সেবাকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ করিয়ে আনতে হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাকর্মীরা অসুস্থ প্রবীণদের সেবা যত্ন, হাসপাতালে ভর্তি করানো, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো, রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো, দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম সহজ উপায়ে সম্পাদনে সহযোগিতা করবে বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে। যেসব প্রবীণ সেবা মূল্য দিতে পারবে না, তাদের সেবা মূল্য কমিউনিটি থেকে দেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এলাকার আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষরা টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে সরকার এবং জনগণের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে তহবিল গঠন করবে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই তারা শারীরিকভাবে প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্রে সেবা দিবে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র যত বেশি শক্তিশালী হবে তত বেশি প্রবীণরা শান্তি ও স্বস্তি বোধ করবে। যেসব প্রবীণ শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম তাদের স্বল্প সুদে কিংবা বিনা সুদে আয় বৃদ্ধি মূলক কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে হবে। যেসব ছেলেমেয়েরা দাদা দাদি, নানা নানি, বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়িকে ভরণপোষণ এবং সেবা যত্ন করে তাদের ৫ শতাংশ সরল সুদে ঋণ দেবার কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে প্রবীণরা সুরক্ষা পাবেন।