ঢাকা সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫, ১০ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সামাজিক অবক্ষয়ের আরেক নাম ধর্ষণ অপরাধ

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
সামাজিক অবক্ষয়ের আরেক নাম ধর্ষণ অপরাধ

সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকার পাতা কিংবা টিভির পর্দা অন করলেই এই ধর্ষণের খবর আগে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে অন্যান্য অপরাধের সাথে ধর্ষণসহ শিশু ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও বিবেকবর্জিত শিশু ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে মাগুড়ার শিশু আছিয়ার ঘটনাটি। মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আট বছরের শিশুকন্যা ধর্ষণ ও নির্যাতনে শিশু আছিয়ার মৃত্যুতে পুরো দেশ শোকাহত হয়েছে। এ ঘটনা শুরু থেকে দেশের সর্বমহলে ধর্ষণের শাস্তি, বিচার প্রক্রিয়া, শাস্তি কার্যকর নিয়ে নেটিজেনরা বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা করছে। (১৩ মার্চ) বেলা ৩টায় সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন- মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া শিশুর ধর্ষণ মামলার বিচার আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হবে।

গত ১২ মার্চ সাংবাদিকদের আইন উপদেষ্টা জানান- ‘ধর্ষণ মামলার বিচার কেবল দ্রুতই নয়, বিচারটা যাতে নিশ্চিত ও যথাযথ হয় সে লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন কঠোর করা হচ্ছে। এরইমধ্যে ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে অর্ধেক করতে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটির খসড়া অনুযায়ী, ধর্ষণের মামলা তদন্তের সময় ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ১৫ দিন এবং মামলার বিচার কাজ শেষ হওয়ার সময় ১৮০ দিন থেকে কমিয়ে ৯০ দিন করা হচ্ছে। বিচারক যদি মনে করেন তবে ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই মেডিকেল সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে মামলার বিচারকাজ ও তদন্তকাজ চালাতে পারবেন- আইনে এমন বিধান রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের আরো বলেন, বিজয় পরবর্তীসময়ে আমাদের দেশে মেয়েদের আক্রমণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েও তাদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি’।

এই ঘটনায় পুরো দেশে আলোচনা এখন ধর্ষণ নিয়ে। কেউ বলছে ধর্ষণের বিচার শরীয়া আইনে ধর্ষককে জনসম্মুখে পাথর নিক্ষেপ করে মারা হোক, আবার কেউ বলছে ধর্ষককে গুলি করে মারা হোক, কেউ বলছে ক্রোস ফায়ার, কেউ বলছে আগুনে পুড়ে মারা হোক কত যে মত। আসলে আমাদের দেশে প্রচলিত আইন উপরের কোনোটিই পার্মিট করে না। এদেশে বর্তমানে ধর্ষণ অপরাধের বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী২০০৩) এর ৯(১),৯(২),৯(৩) এবং ৯(৪) ধারা অনুযায়ী। বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী সাজার ধরণ থাকলেও এই আইনের ৯(২) ধারায় বলা আছে- ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পরে অন্য কোনো কাজের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষণকারী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এছাড়াও তাকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

আছিয়ার এ ঘটনায় সর্বপ্রথম মাগুড়াতে সাধারণ জনগণ বিক্ষোভ করেন অপরাধীর দ্রুত বিচারের জন্য কিন্তু পরবর্তীতে অপরাধীদের দ্রুত ফাঁসির দাবি, বিচারের দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন। আসলে দ্রুত বিচার বলতে যথা সম্ভব দ্রুত অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে আইনি বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত করে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই মামলাটির রায় ঘোষণা করাকেই বুঝায়। যেহেতু ঘটনাটি আলোচিত একটি শিশু ধর্ষণ মামলা তাই বিচারপ্রার্থীরা অপরাধীর সাজা মৃত্যুদণ্ড হোক এটা প্রত্যাশা করছে। আছিয়ার মৃত্যুর খবরে সারা দেশের মানুষ আরো মর্মাহত হয়েছে। বিভিন্নভাবে ধর্ষণকারী ও সহায়তাকারীর দ্রুত শাস্তির দাবিটা যেন আরও বাড়ছে। খবরে এসেছে এরইমধ্যে ক্ষোভে ওই ধর্ষণকারীর বাড়িতে স্থানীয় জনতা আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাড়িটি ভাঙচুর করেছে।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২৯৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র- আসক এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছেন। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনজন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুইজন নারী। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে একজনকে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ২০২৪ সালে ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আসকের পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৬৬ জন নারী। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুইজন ও খুন হয়েছে তিনজন নারী। এছাড়া ২০২৪ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ৫২৩ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৭৪ জন।

এমএসএফ’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে এক হাজার ১৫১ জন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮১ জন নারী ও ৩৩১ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে সাত জনকে, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৮ জন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন।

বিশ্বব্যাপী, প্রায় ৮ জনের মধ্যে একজন মেয়ে ১৮ বছর বয়সের আগে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর অর্থ হলো বর্তমানে জীবিত ৩৭ কোটিরও বেশি মেয়ে এবং মহিলা ১৮ বছর বয়সের আগে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ছেলে এবং পুরুষরাও আক্রান্ত হন, যার আনুমানিক সংখ্যা ২৪০ থেকে ৩১০ মিলিয়ন (প্রায় এগারো জনে একজন) শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সাব-সাহারান আফ্রিকা সর্বোচ্চ হারের রিপোর্ট করে, যেখানে ২২ শতাংশ মেয়ে এবং মহিলা আক্রান্ত হয়, তারপরে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।

বেশিরভাগ যৌন নির্যাতনকারী অপরাধী তাদের ভুক্তভোগীদের সঙ্গে পরিচিত; প্রায় ৩০ শতাংশ শিশুটির আত্মীয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাই, বাবা, চাচা, অথবা চাচাতো ভাই, প্রায় ৬০ শতাংশ অন্যান্য পরিচিত, যেমন পরিবারের ‘বন্ধু’, শিশুসেবক, অথবা প্রতিবেশী; প্রায় ১০ শতাংশ শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অপরিচিত ব্যক্তিরা অপরাধী। বেশিরভাগ শিশু যৌন নির্যাতন পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত হয়; মহিলা শিশু নির্যাতনকারীদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে মহিলারা ছেলেদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা অপরাধের ১৪ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা অপরাধের ৬ শতাংশ করে।

দেশে শিশু ধর্ষণসহ ধর্ষণের একাধিক ঘটনা আগে ঘটলেও এই ঘটনাটি দেশের মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে গেছে। এই ঘটনায় মনে হচ্ছে আমরা পুরুষ জাতি যেন আছিয়ার কাছে বড় অপরাধী হয়ে গেলাম। এ কথার কোনো ভাষা নেই, উত্তর নেই! আছিয়া হয়তো শুনতে পাবে না তবুও এটুকু বলতে পারি আছিয়া তোমার উপর যা নির্যাতন হয়েছে তার উপযুক্ত বিচার এই বাংলার মাটিতেই আইনি প্রক্রিয়ায় দ্রুত হবে এটা আমাদের কাম্য। সারা দেশে শিশু ধর্ষণসহ ধর্ষণের ঘটনাই এখন যেন টক অব দ্য কান্ট্রি। পেপার-পত্রিকা, ফেসবুকে-ইউটিউবে ধর্ষণের খবর। ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ আগেও হতো কিন্তু এত দ্রুত খবর আমরা হয়তো পেতাম না আর এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিরাজমান থাকায় দ্রুত সংবাদটি পাওয়া যায়। এই ঘটনাটিতে প্রমাণ হয় যে, এ ধরনের মানুষের মানসিকতা কত তলানীতে নেমে গেলে বোনজামাই তার নিজের পিতাকে শিশুটিকে ধর্ষণে সহায়তা করে! ধিক্কার জানাই এসব পাষ- মানসিকার মানুষগুলোকে। আর কোনো আছিয়ার যেন এমন করুণ মৃত্যু না হয়, আর কোনো আছিয়া যেন ধর্ষিত না হয়। যেজন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন, প্রয়োগ ও বিচারকার্যের দ্রুত প্রক্রিয়া সম্পন্নে বিচারকদের সদিচ্ছা বৃদ্ধি হওয়া দরকার। আইন ও সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি এ ধরনের জঘন্য অপরাধ রোধে দেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। আমরা যদি এ ধরনের জঘন্য অপরাধের বিচারের দায় আইন-আদালতের উপর ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে চলবে না। আমাদের সচেতন মহলেরও সমাজে কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। নিজ নিজ পরিবারের সন্তানদের পরিবার প্রধানরা যেন এ ধরনের অপরাধ রোধে সামাজিকভাবে সচেতন থাকে। সর্বোস্তরে ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। সমাজে এ ধরনের অপরাধ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করলেই অপরাধের রাশ টেনে ধরা যেতে পারে।

আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত