ঢাকা বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামে ইতেকাফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : সহি আকিদা অনুসরণ

আ. ছালাম খান
ইসলামে ইতেকাফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : সহি আকিদা অনুসরণ

ইসলাম মানবজাতির কল্যাণের জন্য এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে আত্মশুদ্ধি, ইবাদত ও নৈতিক উন্নতির জন্য নানা বিধান রয়েছে। ইতেকাফ হলো ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা বিশেষ করে রমজান মাসের শেষ দশকে পালিত হয়। এটি আত্মার পরিশুদ্ধি লাভ, আল্লাহর

সান্নিধ্য অর্জন ও ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা বৃদ্ধির অনন্য সুযোগ এনে দেয়। সহি আকিদার অনুসরণে ইত্তেকাফের সঠিক নিয়ম ও তাৎপর্য বোঝা আবশ্যক, যাতে আমরা শিরক, বিদআত ও অন্য কোনো গোমরাহি থেকে বেঁচে থেকে খাঁটি ইসলামের পথে চলতে পারি। এই প্রবন্ধে কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইতেকাফের গুরুত্ব, তাৎপর্য, মাজিক প্রভাব ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। ইতেকাফের সংজ্ঞা ও মূল ব্যাখ্যা : আরবি ভাষায় ‘ইতেকাফ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনো স্থানে অবস্থান করা বা নিজেকে নিয়োজিত রাখা। ইসলামি শরিয়তে ইতেকাফ বলতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মসজিদে অবস্থান করা এবং আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করাকে বোঝায়।

কোরআনে ইতেকাফের বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে: ‘আর তোমরা যখন মসজিদে ইতেকাফরত থাক, তখন তোমাদের জন্য নারীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা বৈধ নয়।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৭) এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইতেকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা রমজানের নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষভাবে পালন করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও ইতেকাফ পালন করতেন। হাদিসে এসেছে: ‘রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমজানের শেষ দশকে নিয়মিত ইতেকাফ করতেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ আমল অব্যাহত রাখেন।’ (সহিহ বুখারি: ২০২৬, মুসলিম: ১১৭২) এ থেকে বোঝা যায়, ইতেকাফ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এবং এটি আত্মার পরিশুদ্ধি, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার মাধ্যম।

ইতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত: ১. আত্মার পরিশুদ্ধি লাভের মাধ্যম: ইতেকাফের মূল লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধি। আল্লাহর ঘরে নির্জনে অবস্থান করে বেশি বেশি ইবাদত, তাওবা, জিকির ও কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বান্দার আত্মা পবিত্র হয়।

২. আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন : ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষ পার্থিব ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হয়, যা তার ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে।

৩. লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান: ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের ফজিলত অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম (সুরা আল-কদর: ৩)। ৪. অহেতুক কাজ থেকে মুক্তি: ইতেকাফ মানুষকে দুনিয়াবি অহেতুক কাজ থেকে ফিরিয়ে আনে এবং ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা সৃষ্টি করে।

ইতেকাফের মাজিক প্রভাব ১. মন ও মস্তিষ্কের প্রশান্তি: দুনিয়ার ব্যস্ততা ও উদ্বেগ থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে ইবাদত করা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। ২. নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ: ইতেকাফ মানুষকে তার নফসের নিয়ন্ত্রণ শেখায় এবং খারাপ অভ্যাস থেকে মুক্তি দেয়। ৩. সামাজিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন: ইতেকাফ পালনকারী ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজে ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও উদারতার প্রসার ঘটাতে পারে।

ইতেকাফের বিধান ও শর্তাবলি : ১. ইতেকাফ পালনের স্থান: ইতেকাফ কেবল মসজিদে আদায় করা যায়। নারীরা বাড়ির নির্দিষ্ট একটি স্থানে (নামাজের স্থান) ইতেকাফ করতে পারেন। ২. সময়ের সীমা: রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ ২০ রমজানের সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু হয় এবং শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত চলে। ৩. ইতেকাফকারী যা করতে পারবেন: নামাজ আদায় করা, কোরআন তিলাওয়াত করা, জিকির ও তাসবিহ পাঠ করা, দোয়া ও তাওবা করা।

৪. ইতেকাফ ভঙ্গের কারণ: মসজিদ থেকে বিনা কারণে বের হয়ে যাওয়া, শারীরিক ও মানসিকভাবে ইবাদত চালিয়ে যেতে অক্ষম হওয়া, ইতেকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, ইতেকাফ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ করে দেয়। এটি দুনিয়ার মোহ থেকে দূরে থেকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টার নাম। হাদিসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতেকাফ করে, আল্লাহ তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দকের দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন।’ (সহিহ বায়হাকি: ৩৭৩)

সুতরাং, ইতেকাফ পালনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত অর্জন করতে পারে এবং তার পরকালের সফলতার পথ সুগম করতে পারে। ইতেকাফ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায় এবং আত্মশুদ্ধির পথ প্রশস্ত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই ইবাদত পালন করতেন এবং উম্মতের জন্য এটি সুন্নত হিসেবে রেখে গেছেন। সহি আকিদার ভিত্তিতে ইতেকাফ পালনের মাধ্যমে আমরা দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে খাঁটি ইবাদতের স্বাদ পেতে পারি। আসুন, আমরা সবাই ইতেকাফের গুরুত্ব বুঝে তা পালন করি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের ইতেকাফ কবুল করুন এবং তার রহমত বর্ষিত করুন আমিন।

মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত