দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর দেশের মানুষ উদযাপন করবে পবিত্র ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশে ঈদ মানেই উৎসবের আমেজ, প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দ। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কর্মজীবী মানুষ ছুটে যাবে আপন ঠিকানায়। কিন্তু এই আনন্দযাত্রা অনেক পরিবারের জন্য বেদনায় পরিণত হয় রোডক্র্যাশের কারণে। প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের মহাসড়কগুলোতে ভয়াবহ রোডক্র্যাশ ঘটে, যা বহু প্রাণ কেড়ে নেয়। দেশের সড়ক পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে ঈদের আগে-পরে ১৭ দিনে দেশে সব মিলিয়ে ২৮৬টি রোডক্র্যাশ সংঘটিত হয়েছে। এসব রোডক্র্যাশে ৩২০ জন নিহত ও ৪৬২ জন আহত হয়েছে। এ সময়ে গড়ে প্রতিদিন ১৭টি রোডক্র্যাশ ঘটেছে। প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নিহত ও ২৭ জন আহত হয়েছে। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল, অদক্ষ চালক, ট্রাফিক আইন না মানা, হেলমেট পরিধান না করা, অতিরিক্ত গতি, মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো এবং যাত্রীদের অসচেতনতা এসব কারণে রোডক্র্যাশের সংখ্যা বাড়ে। অথচ এই রোডক্র্যাশগুলো অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য।
আর এসব রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে প্রয়োজন একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’। রোডক্র্যাশ কমাতে সরকারের কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। ঈদের সময় অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ সামলাতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিষিদ্ধ করতে হবে এবং চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার, যাতে যানজট ও রোডক্র্যাশের ঝুঁকি কমানো যায়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, গণমাধ্যমে প্রচারণা এবং সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। বর্তমান ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’ যথেষ্ট কার্যকর না হওয়ায় এবং দেশে কোনো সড়ক নিরাপত্তা আইন না থাকায় রোডক্র্যাশের সংখ্যা কমছে না। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ অনুসরণ করে একটি আধুনিক ও কার্যকর নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা জরুরি। এই আইনের মাধ্যমে মহাসড়ক ও নগর সড়কে গতিসীমা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ হয়। যানবাহনে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিটবেল্ট ও মানসম্মত হেলমেট বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা দুর্ঘটনার সময় মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে।
বিশেষ করে, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যানবাহনে শিশুবান্ধব আসন সংযোজন প্রয়োজন, যা পরিবারগুলোর জন্য নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করবে। এছাড়া, মাদকাসক্ত চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে রোডক্র্যাশের সংখ্যা কমে আসে। সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ঈদসহ যে কোনো উৎসবের সময় সড়কে প্রাণহানি অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। ঈদে মোটরসাইকেল চালক এবং আরোহীদের অবশ্যই গতিসীমা মেনে চলা ও মানসম্মত হেলমেট পরার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার, কারণ ঈদযাত্রায় রোডক্র্যাশের একটি বড় অংশ মোটরসাইকেলের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারণেই ঘটে। দেশে রোডক্র্যাশ কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, একজন যাত্রী ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারবে কি না অথবা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড শেষে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে কি না এ নিয়ে প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়। সড়কে ভয়াবহতা বিশ্লেষণ করে ও নিরাপত্তার দাবিতে আমরা একটি নতুন আইন প্রনয়ণের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার ও নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছি কারণ একটি পৃথক ও কার্যকরী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না হলে সড়কে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.৬ অর্জনে ২০২০-২০২৫ সালের মধ্যে রোডক্র্যাশে প্রাণহানির সংখ্যা ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি সরকার বৈশ্বিক পর্যায়েও ২০৩০ সালের মধ্যে রোডক্র্যাশে নিহত ও আহতের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু দুই ঈদ এ যেভাবে রোডক্র্যাশে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করণে একটি কার্যকরী পৃথক আইনের কোনো বিকল্প নেই এবং যেখানে জাতিসংঘ ঘোষিত সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ অন্তর্ভুক্ত থাকা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি দরকার জোরালো জনসমর্থন। আমরা কোনোমতেই এমন অনিরাপদ সড়ক চাই না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সড়কে নজরদারি জোরদার করতে হবে। অনিয়ম কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। রোডক্র্যাশের নামে হত্যাকাণ্ড রোধে সরকার দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে- এই দাবি সবার। একটি নিরাপদ, শৃঙ্খল ও জনবান্ধব সড়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। সড়ক নিরাপত্তা আইন চাই, নিরাপদ জীবন চাই- এটাই আমাদের প্রত্যাশা! সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং জনগণের সচেতনতাণ্ড এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটলে ঈদের আগের ও পরের রোডক্র্যাশ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত হলে প্রতিটি মানুষ আনন্দময়ভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারবে এবং দেশের প্রতিটি ঘরে উৎসবের খুশি ছড়িয়ে পড়বে।
অ্যাডভোকেসি অফিসার (পলিসি) রোড সেফটি প্রকল্প ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন