সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। বলা হয় এটি সমাজের দর্পণ এবং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা এবং জনগণকে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দেয়া সাংবাদকর্মীদের কাজ। কিন্তু এখন সাংবাদিকতার চেয়ে ভিউ সাংবাদিকতার প্রভাব বেশি।
বর্তমানে কিছু ভিউ-ভিত্তিক সাংবাদিকতার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেখানে সংবাদ পরিবেশনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র বেশি দর্শক বা পাঠক আকর্ষণ করা। এটি সাংবাদিকতার মূল নীতিগুলোকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে। অথচ দিনের পর দিন আমরা ভিউর পেছনে ছুটছি। এই ভিউর পেছনে ছুটতে গিয়ে একটি সংবাদ কখনও অতিরঞ্জিত হয়, কখনও বিভ্রান্তিকরও হয়।
আর অধিক ক্লিক বা দর্শক পাওয়ার জন্য বর্তমানে ইচ্ছা করেই সংবাদ অতিরঞ্জিত বা বিকৃত করা হয়। ক্যাপশন, শিরোনাম, থামনেইলে উত্তেজনাপূর্ণ, চটকদার এবং বিতর্কিত বিষয়গুলো এখন বেশি গুরুত্ব পায়, যার মাধ্যমে বেশি ভিউ কিংবা ক্লিক হবে। অথচ এটা যে সাংবাদিকতার সুনাম ও মর্যাদা নষ্ট করছে সেদিকে আমরা নজর দিচ্ছি না। কিছু ভিউর জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ প্রকাশ করা মোটেও কাম্য নয়। এটি গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি ফেসবুক এবং ইউটিউবে দেখা যায় কিছু গণমাধ্যম ঈদের কেনাকাটার সংবাদ করতে গিয়ে সস্তা কন্টেন্ট তৈরি করছে। যেখানে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ভিউ ব্যবসা করছে তারা। কাউকে ঈদের শপিং করার জন্য বাজেট কত প্রশ্ন করে বিব্রত করছে, আবার কাউকে বাজেট বেশি হওয়ার জন্য বিব্রত হতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ভাইরাল হয়, ওই গণমাধ্যমের ভিউ হয়। কিন্তু বাস্তবে মানুষের আবেগ ও সম্মান এই দুটো নিয়েই খেলা হয়। গত ২২ মার্চ একটা ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায় শপিং করতে আসা এক নারীকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করছেন, ঈদ শপিংয়ের জন?্য আপনার বাজেট কত? ভদ্রমহিলা বললেন, ‘৫০০০ টাকা’। রিপোর্টার আবার প্রশ্ন করেন, এই টাকা দিয়ে আপনার পুরো পরিবারের শপিং হবে? ভদ্রমহিলার উত্তর, ‘কি আর করা? যা বাজেট, তার মধে?্যই তো শপিং করতে হবে।’
এরপর আবার প্রশ্ন করা হয়, ‘এইযে কেউ একলাখ টাকার শপিং করছে, আবার কেউ ৫ হাজার টাকা নিয়ে শপিংয়ে আসছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?’ এবার ভদ্রমহিলা প্রশ্ন শুনে আর মনটা শক্ত রাখতে পারলেন না। মুহূর্তেই কেঁদে ফেললেন। এটা নিয়ে এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ এমন সাংবাদিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ আবার ভদ্রমহিলার কান্নায় নিজেও ব্যথিত হয়েছেন।
এই ঘটনা নিয়ে কাজী নিপু নামের একজন লিখেছেন, কোন জায়গায় থামতে হবে, এই বোধটা আমাদের কোনোকালেই খুব একটা ছিলো না; আজও হয়নি। একসময় মনে হতো, আর পাঁচবছর পর চেঞ্জ আসবে, আর দশবছর পর হয়তো সব বদলে যাবে। দেখতে দেখতে ২০২৫-এ চলে আসলাম। তেমন কিছুই বদলাল না। কিছু বদলাক আর না বদলাক, অন্তত শপিংমলে অন ক্যামেরায় জনে জনে মাইক্রোফোন ধরে শপিংয়ের বাজেট জানতে চাওয়ার এই কুৎসিত কালচারটা বন্ধ হওয়া উচিত। কোথায় গিয়ে থামতে হবে, এটা আমাদের বোঝা দরকার।
শুরুতেই বলেছি, সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। এই পেশা নিয়ে সম্মানের সাথেই মন্তব্য করতে চাই। কোথায়, কতটুকু সাংবাদিকতা করতে হবে এটুকুও আমাদের জানা উচিত। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এটা আমাদেরও বোঝা দরকার। মানুষকে বিব্রত করার নাম সাংবাদিকতা হতে পারে না, কারও চোখের জল আনতে বাধ্য করাকে সাংবাদিকতা বলে না। এতে করে উল্টো সাংবাদিকদের মানসিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
যদিও আমার এসব কথার সাথে অনেকেই একমত হবেন না। অনেকেই সাংবাদিকতাকে অনেকভাবে দেখেন। বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলোর রুচিরও পরিবর্তন এসেছে। একেক গণমাধ্যমের একেক ধরনের রুচি। সংবাদ পরিবেশনের স্টাইল, সংবাদের বিষয়বস্তু সবকিছুতেই এখন ভিন্নতা এসেছে।
আগে যা মানুষ পছন্দ করতো এখন তা করে না, আগে যা মানুষ দেখত এখন তা দেখে না। আর একারণে সংবাদ মাধ্যমগুলো তাদের নিজস্বতা ধরে রাখতে পারছে না, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে তাদের সংবাদের বিষয়বস্তু। তবে আর যাই হোক, কাউকে বিব্রতা করার মাধ্যমে সংবাদচর্চা না হোক।