ঢাকা বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হতে পারে না

আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হতে পারে না

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিগত সাত মাস ধরে নানা আলোচনা চলছে। হাসিনার পতনের পরপরই শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। তাদের এ দাবি কিছু রাজনৈতিক দল সমর্থন জানায়। তবে বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপি সে সময় স্পষ্ট করে বলে দেয়, সে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। জনগণ যদি নিষিদ্ধ করে তবে তাতে আপত্তি নেই। বিএনপির এই অবস্থানের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের বিষয়টি আপাতত আড়ালে চলে যায়। তবে গত দুই দিন ধরে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা সমাবেশ করেছে। তারা আওয়ামী লীগকে সরাসরি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হবে, নাকি তার নিবন্ধন বাতিল করা হবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা মতদ্বৈততা আছে। কেউ বলছেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে, কেউ বলছেন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। আবার কেউ বলছেন, রিফাইন্ড বা শেখ হাসিনাসহ তার দোসর বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের মাধ্যমে নতুন ফ্রেস নেতৃত্বের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ফেরার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে রিফাইন্ড বা অন্য কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন এখনই যাতে না হয়, তার পক্ষে মত জোরালো হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ গত বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পোস্টের মূল ভাব হচ্ছে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে এবং আরও দুজনকে শর্ত সাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রস্তাবে রাজি হতে বলা হয়। ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়, আওয়ামী লীগকে রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ করা হবে। রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে। এ প্রস্তাবে হাসনাত আব্দুল্লাহ রাজী হননি এবং বলেছেন, পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হবে কি না এমন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা সরকারের নেই। তার এই বক্তব্যে এনসিপি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার যে কোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা হবে। পাপমোচন ও অনুশোচনা ছাড়া আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য হুমকি স্বরূপ। তিনি বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয়, যাতে স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হয়। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিচারের পর জনগণ আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে কিছু বলার নেই। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পতিত আওয়ামী লীগই দায়ি। বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দলটিকে ফ্যাসিস্ট দলে পরিণত করার কারণে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার শিক্ষার্থীদের দাবি উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, গণঅভ্যুত্থানে এই শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি হাসিনার পুলিশ বাহিনীর বুলেটে নিহত হয়েছে। আবার এটাও সত্য শুরুতে সেনাবাহিনী সরকারের পক্ষ নিলেও শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা মেনে নিতে না পেরে সে অবস্থান থেকে সরে আসে। সেনাপ্রধান সরকারের পক্ষাবলম্বন করেননি। অন্যদিকে, বুকে পাথর বেঁধে হলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনে নিয়েছেন। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই, সে সময় সেনাবাহিনী আন্দোলনে সমর্থন না দিলে আরও অজস্র প্রাণ ঝরে যেত, রক্তের ¯্রােত তীব্র হতো। মূলত হাসিনার পাশ থেকে সেনাবাহিনী সরে যাওয়াতেই তার পতন দ্রুতায়িত হয়েছে। সে কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। যে পুলিশ বাহিনী হাসিনার ফ্যাসিজমের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, তারা ডিমরালাইজড হয়ে ট্রমাটিক পরিস্থিতিতে চলে গেছে। এখনও পুলিশ বাহিনী ট্রমা কাটিয়ে পুরোপুরি পেশাদারিত্বে ফিরতে সংগ্রাম করছে। কাজেই, অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর বড় ধরনের ভূমিকা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। বিশেষ করে সেনাপ্রধানের। সে সময় তিনি যদি হাসিনার পক্ষাবলম্বন করতেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও করুণ কিংবা ভয়াবহ হতে পারত। এ কথা সত্য, পুলিশ, প্রশাসন, আদালতসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার একনিষ্ঠ দোসর ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যেও ছিল বা আছে। যথাযথ নিয়মে তাদের বিচার হওয়া অবশ্যই উচিত। তবে তাদের কারণে, পুরো সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ বানানো এবং সেনা প্রধানকে লক্ষ্যবস্তু করা মোটেই সমীচীন হতে পারে না। এখন দেখা যাচ্ছে, একটি পক্ষ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে নিশানা করে তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তাকে অপসারণ বা বরখাস্ত করার দাবি করছে। দেশের বাস্তবতার নিরিখে এ ধরনের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বোঝা উচিত, সেনাবাহিনী হচ্ছে দেশের নিরাপত্তার সর্বশেষ স্তর। একে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত বা দুর্বল করলে দেশের অস্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। আবার কেউ কেউ এখন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তার প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার দ্বারা যেভাবে নিগৃহীত ও অপমানিত হয়েছিলেন, তার ও তার দলের প্রতি তার কোনো সিমপ্যাথি থাকার কথা নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের প্রতি তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও টান অস্বীকার কারার কোনো সুযোগ নেই।

সেই তিনি যখন বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই, তখন বুঝতে হবে তিনি কেন বলেছেন। এটা বুঝতে হবে, রাজনৈতিক পরিবর্তন শুধু আমাদের দেশেই হয়নি, উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বের রাজনীতিতে ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটছে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বাস্তবতার নিরিখে ও কৌশলগত অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে তাকে এ কথা বলতে হয়েছে। মনে রাখতে হবে, হাসিনার পতনের পর যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব না নিতেন, তাহলে দেশ ফের ভারত এবং আওয়ামী লীগের যৌথ দখলে চলে যেত। শুধু তার মতো বিশ্ব নন্দিত একজন মহীরুহর দায়িত্ব নেয়ায় আল্লাহর অশেষ রহমতে দেশ দাঁড়ানোর মতো ভিত্তি পায়। অন্য কেউ হলে, হয়তো আজাকের এই বাংলাদেশের পরিস্থিতি থাকত না। এখন দেখা যাচ্ছে, যেভাবেই হোক দেশের সংকটময় মুহূর্তে সেনাপ্রধান ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে অসামান্য দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করেছেন এবং করছেন তাদেরকে এখন কোনো কোনো মহল প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। এটা যে ডেলিভারেটলি করা হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। তারা একটি ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, যে পরিস্থিতি শুধু ভারত ও আওয়ামী লীগের সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের সচেতন ও সম্বিত ফিরে পাওয়া জরুরি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত